আমাদের বেঁচে থাকার জন্য পানি অপরিহার্য। ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৭১ শতাংশ এলাকাজুড়ে রয়েছে পানি। কিন্তু এই পানির প্রায় ৯৭ শতাংশই হলো লবণাক্ত বাকি ৩ শতাংশ পানযোগ্য মৃদু পানি। এই ৩ শতাংশ পানির আবার দুই-তৃতীয়াংশই বরফ আকারে রয়েছে, যা সহজে প্রাপ্য নয়। তাই সঙ্গত কারণেই পৃথিবীর বেশির ভাগ মহাদেশ ও দেশজুড়ে বিভিন্ন সাগর ও মহাসাগর থাকলেও বর্তমানে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশই পানযোগ্য মৃদু পানির সংকটের শিকার।
বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০২৫ সাল নাগাদ পৃথিবীজুড়ে প্রায় ১.৮ বিলিয়ন মানুষ পানি সংকটে ভুগবে। ২০১০ সালে নেচারে প্রকাশিত এক জার্নাল থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, পৃথিবীর প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ পানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে, এমন এলাকায় বসবাস করে। পৃথিবীতে যে হারে মানুষ বাড়ছে তার প্রায় দ্বিগুণ হারে বাড়ছে পানির চাহিদা। ধারণা করা হচ্ছে ২০৪০ সাল নাগাদ প্রায় ২০টি দেশ এবং ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় ৫ বিলিয়ন মানুষ তীব্র পানি সংকটের সম্মুখীন হবে। কনসালটিভ গ্রুপ অব ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ পানি সংকটের মুখে রয়েছে, এমন কয়েকটি দেশের তালিকা করেছে। তালিকার ওপরের দিকে রয়েছে উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, কেন্দ্রীয় এশিয়া, চীন, চিলি, কলোম্বিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়া। ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে তীব্র পানি সংকট রয়েছে। উত্তর প্রদেশে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয় শুধু একটু বিশুদ্ধ খাবার পানির খোঁজে। ভারতের কয়েকটি রাজ্যের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। কাভেরি, কৃষ্ণ, রবি, নর্মদা, গোদাভরি ইত্যাদি নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলাতেও পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ দেশের দক্ষিণের জেলাগুলোয় পানিতে লবণের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমানে পৃথিবীতে পানি সংকটের প্রধান তিনটি কারণ হলো অতীতের তুলনায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়া, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং মৃদু পানির উৎসগুলো হ্রাস পাওয়া। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমরা যে পরিমাণ পানি খরচ করি তার একটা ক্ষুদ্র অংশ বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে আবার ফিরে আসে। তাই পানি সংকটের সমাধান করতে হলে আমাদের প্রথমেই পানির পুনঃব্যবহারের (জবপুপষরহম ড়ভ ডধঃবৎ) দিকে মনোযোগী হতে হবে। অন্যদিকে মৃদু পানির একটি বড় অংশ ব্যবহার করা হয় কৃষিকাজে। তাই বিভিন্ন ধরনের সেচ সাশ্রয়ী ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা পানির সংকট অনেকটা কমিয়ে আনতে পারি। একজন মানুষ প্রতিদিন যে খাবার খায়, সেটা উৎপাদনের জন্য প্রায় ৩৫০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। তাই খাবারের অপচয়রোধ করার মাধ্যমেও পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব। অন্যদিকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে আমরা আমাদের পানির চাহিদা অনেকটা মেটাতে পারি। ১০০০ বর্গফুট ছাদে ১ ইঞ্চি পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলে প্রায় ৬০০ গ্যালন পানি জমা হয়। এই বিপুল পরিমাণ পানি অব্যবহূত রাখা কোনো ভালো কথা নয়। তাই বর্তমানে মৃদু পানির সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদেরকে বৃষ্টির পানির পূর্ণ ব্যবহারের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। সমুদ্রের তীরবর্তী দেশ বারমুডা এ ক্ষেত্রে একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে। চারদিকে লোনা পানি দিয়ে ঘেরা দেশটি তাদের পানির প্রায় পুরো চাহিদাটাই মেটায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে। জলবায়ুর পরিবর্তন তথা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পানি সংকটের অন্যতম কারণ। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর বরফ গলে সমুদ্রের সাথে মিশে যাওয়ায় মৃদু পানির উৎস ক্রমাগত ছোট হয়ে আসছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের নিয়ামকগুলো কমিয়ে আনতে আমাদের সকলকে সচেষ্ট হতে হবে।
বিশ্বজুড়ে পানি সংকটের সমাধান হিসেবে যে বিষয়ের ওপর সব থেকে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে, তা হলো পানি নির্লবণীকরণ। কিন্তু সমুদ্রের লোনা পানিকে লবণমুক্ত করে পানযোগ্য এবং কৃষিকাজে ব্যবহার করা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ একটি পদ্ধতি, যা পানি সংকটে থাকা সব দেশের পক্ষে সম্ভব নয়। পানি নির্লবণীকরণ করতে ইসরাইলে প্রতি ঘনমিটারে ৫৩ সেন্ট এবং সিঙ্গাপুরে ৪৯ সেন্ট খরচ পড়ে। এ ছাড়া পানি নির্লবণীকরণ প্রক্রিয়াটি অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক থেকেও টেকসই নয় এবং প্রচুর পরিমাণে শক্তি শোষণ করে থাকে। তাই সঙ্গত কারণেই পানি নির্লবণীকরণের দিকে মনোযোগ না দিয়ে আমাদের উচিত পানি সংরক্ষণ এবং পুনঃব্যবহারের দিকে মনোযোগ দেওয়া।
তীব্র পানি সংকটের মুখে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না সে আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পানি সংকটে থাকা দেশগুলো পানি নিয়ে ভবিষ্যতে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে পারে, এ বিষয়ে একমত অনেকেই। ধারণা করা হয়, আগামী শতাব্দীতে বিশ্বযুদ্ধ হবে পানি নিয়ে। ১৯৬৭ সালে যে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ হয়েছিল তার অন্য একটি নিয়ামক ছিল পানি। শাত-ইল-আরব নদী নিয়ে ইরান ও ইরাকের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। ভারত-পাকিস্তান এবং ভারত-চীনের মধ্যে বেশ কয়েকটি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে সমস্যা রয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশেরও বেশ কয়েকটি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চীন মেকং নদীতে বাঁধ নির্মাণ করছে। এই বাঁধ নির্মাণের ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া এবং থাইল্যান্ডে পানির সংকট দেখা দিবে। এর ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে, যার পরিনতিতে ওই অঞ্চলে অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। এভাবে দেশগুলো যদি পানিকে কেন্দ্র করে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে সেটা একটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে অবস্থিত নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। ভবিষ্যতে পানি সংকট প্রকট হলে এ সমস্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। বিভিন্ন মৃদু পানির উৎসগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ দাবি করতে চাইবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো। এর ফলে বিশ্ব জুড়ে বৃদ্ধি পাবে অস্থিরতা। এর পরিপ্রেক্ষিতে একটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা প্রবলভাবে উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। ১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সেরাজেডিন বলেছিলেন, ‘The wars of this century were fought over oil. The wars of the next century will be fought over water unless we change our approach to managing this precious and vital resource । সুতরাং পানির উৎস এবং তা সংরক্ষণে বিশ্ববাসীকে এখনি সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি ভূ-প্রকৃতিগতভাবে বিশিষ্ট নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের নদী-খাল-জলাশয়গুলো রক্ষায় সরকারসহ আমাদের সকলকে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগী হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
আফসানা রিজোয়ানা সুলতানা
লেখক : শিক্ষার্থী
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়