এস. কে সাহেদ:
এক সময়ের প্রমত্তা তিস্তা নদীতে পানি না থাকায় দেশি প্রজাতির মাছ, জেলে, নৌকা, নদীপারের চাষাবাদসহ জীববৈচিত্রের ওপর প্রভাব পড়েছে। একসময় তিস্তায় প্রচুর ভুট্টার আবাদ হলেও এখন আর হচ্ছে না। বালু চরের কয়েকটি স্থানে শুধু চিনাবাদাম, মিষ্টি কুমড়া ও তরমুজ চাষ করছেন কৃষকরা।
জানা গেছে, তিস্তা অববাহিকার রংপুর, নীলফামারি, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা জেলার ৫ হাজার ৪২৭টি গ্রামের মানুষ জীবিকার জন্য এই নদীর ওপর নির্ভরশীল। তাই তিস্তায় পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় এখানকার মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম অনিশ্চয়তা। তিস্তা অববাহিকার ৮ হাজার ৫১ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভারতের পাহাড়ি অঞ্চল। সমতল ভূমিতে তিস্তা অববাহিকা ৪ হাজার ১০৮ বর্গকিলোমিটার। তার প্রায় অর্ধেক অংশ পড়েছে বাংলাদেশের সীমানায়। দুই দেশই তিস্তার পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সময়ে নদীর ওপর ও আশপাশে ব্যাপক অবকাঠামো তৈরি করেছে। ভারত জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ কার্যক্রমের জন্য তিস্তার পানি ব্যবহার করছে।
তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প সুত্রে জানা গেছে, চলতি রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে ২৫ জানুয়ারি থেকে সেচ দেওয়া শুরু হয়। শুরুতে সেচ দেওয়া হয় নীলফামারির জলঢাকা উপজেলায়। পরবর্তীকালে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সেচ দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। উজানে পানি প্রবাহ দিন দিন কমায় তিস্তা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় সম্পূরক সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এবার এসব গ্রামের কৃষকদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সেচ দিতে হবে।
শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি প্রবাহ রেকর্ড পরিমাণ কমেছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে তিস্তা ব্যারাজের সেচ প্রকল্পের জন্য ১০ হাজার কিউসেক পানি প্রয়োজন। কিন্তু সেচের জন্য পাওয়া যাচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ কিউসেক।
জানা গেছে, ভারত ৬৮ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যৎকেন্দ্র এবং ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমির সেচের চাহিদা মিটিয়ে যে পরিমাণ পানি ছাড়ে, তা দিয়ে বোরো মৌসুমে আমাদের দেশে সেচ চাহিদার অর্ধেকও পূরণ হয় না। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি প্রবাহ ছিল প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কিউসেক। তা ২০০৬ সালে নেমে আসে ১ হাজার ৩৪৮ কিউসেকে। ২০১৯ সালে পানি প্রবাহ ছিল মাত্র ৭০০ কিউসেক। ১৯৯৩-৯৪ শস্য বছর থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১২টি উপজেলায় ব্যাপকভাবে আউশ ও আমন উৎপাদনের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তিস্তার পানি দিয়ে সেচ কার্যক্রম শুরু হয়।
২০০৬-০৭ শস্য বছর থেকে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বোরো মৌসুমেও সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়। আমন মৌসুমে মোট সেচযোগ্য ৭৯ হাজার ৩৭৯ হেক্টর এলাকার প্রায় পুরোটাই সেচের আওতায় আনা সম্ভব হলেও বোরোর ক্ষেত্রে পানির দুষ্প্রাপ্যতায় সেচ-সাফল্যের চিত্র একেবারেই হতাশাজনক। শুকনো মৌসুমে ভারতের পানি প্রত্যাহারের পর তিস্তা নদীতে যে সামান্য পানি পাওয়া যায়, তার সবটুকুই সেচ চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের সেচ খালের মাধ্যমে কৃষিজমিতে সরবরাহ করা হচ্ছে। এর ফলে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা ব্যারাজের পর থেকে ৯৭ কিলোমিটার বিস্তৃত তিস্তা নদীতে পানিও থাকছে না। এ কারণে তিস্তা অববাহিকার বাংলাদেশ অংশের এই বিশাল পরিমাণ নদীগর্ভ পরিণত হচ্ছে বালুচরে। তিস্তা ব্যারাজ শুকনো মৌসুমে এভাবেই নদী আধমরা হয়ে যাচ্ছে।
তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প সস্প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউল বারী জানান, ২০১৯ সালে ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও পানি সরবরাহ করা হয়েছে ৪০ হাজার হেক্টরে। এরপরও ৪৩ হাজার হেক্টর জমি সেচ-সুবিধার বাইরে ছিল। ২০১৪ সালে বোরো মৌসুমে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা ও দিনাজপুর জেলার ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু সেচ দেওয়া হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সেচ দেওয়া হয় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৭ সালে মাত্র ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ হাজার হেক্টরে দাঁড়ায়। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সেচ দিলে কৃষকদের হেক্টর প্রতি বাড়তি খরচ হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। সে হিসেবে ৪৩ হাজার হেক্টরে কৃষকদের বাড়তি খরচ পড়বে প্রায় ৬৫ কোটি টাকার।