পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। মূলত দীর্ঘকাল ধরেই অভ্যন্তরীণ বাজার ও বিদেশে রপ্তানির জন্য বাংলাদেশ পাট এবং পাটজাতসামগ্রী উৎপাদন করছে। দেশীয় কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা পাট ও পাটজাত পণ্য জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থান এবং মূল্য সংযোজনের নিরিখে অপার সম্ভাবনাময় খাত। কাঁচাপাট ও পাটজাত পণ্য বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রপ্তানিসামগ্রী। পাট চাষ ও পাটশিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আবহমান বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এটি ব্রিটিশ শাসনামলে এবং পাকিস্তানি আমলে একক বৃহত্তম খাত। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশ ও ইউরোপের পাটকলগুলোর প্রয়োজনীয় কাঁচা পাটের সিংহভাগই সরবরাহ করা হতো তদানীন্তন বাংলা থেকে। ১৯৫০-৭০ সময়কালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত পাট ও পাটজাতসামগ্রী পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও এই শিল্পের অবদান কম নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় অন্যান্য পণ্য রপ্তানির সুযোগ না থাকলেও শুধু পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। কিন্তু আশির দশকে প্লাস্টিক ও পলিথিনের সহজলভ্যতার ফলে পৃথিবীজুড়ে কমতে থাকে পাটের চাহিদা। এরপর ধারাবহিক লোকসানে বন্ধ হয়ে যায় অনেকগুলো পাটকল, কমে আসে পাটের উৎপাদন ও রপ্তানি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে পরিবেশ সচেতনতায় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে বহুমুখী পাট জাতীয় পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাট ও পাটপণ্য ক্রমবর্ধমান চাহিদা বাংলাদেশের পাটশিল্পের সামনে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
সোনালি আঁশ খ্যাত পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়। সুপ্রাচীনকাল থেকেই এদেশের মানুষ দৈনন্দিন প্রয়োজনে পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার করে আসছে। বর্তমানে পাট চাষ, পাটজাত পণ্য উৎপাদন, পাট ও পাটজাত দ্রব্যাদির ব্যবসা-বাণিজ্য বাংলাদেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবিকা নির্বাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের জলবায়ু ও মাটি পাট চাষের উপযোগী হওয়া ফলন ভালো হয়। পাট চাষের জন্য উষ্ণ জলবায়ু ও প্রচুর বৃষ্টিপাত দরকার, যা বাংলাদেশ বিদ্যমান। সাময়িক খরা অথবা জলাবদ্ধতায় পাট ফসল তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের ভরা বর্ষায় পাটগাছ কেটে নিকটবর্তী জলাশয়ে পাট গাছ জাগ দেয়া হয়। পাটের আঁশ পচে নরম হলে তা ছাড়িয়ে রোদে শুকিয়ে কৃষিকরা তা পাইকারদের কাছে বিক্রি করে। অর্থকরী ফসল হিসেবে পাট এদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে যতটা অবদান রাখছে অন্য কোনো ফসলের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। মূলত যুগ যুগ ধরে বাংলার মানুষের আর্থিক সচ্ছলতার মূলে ছিলো পাট।
কিন্তু স্বাধীনতাযুদ্ধের নয় মাসে অন্যসব খাতের মতো পাট শিল্পও ক্ষতির শিকার হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পাটের গুদামে অগ্নিসংযোগ, কারখানা ধ্বংস, কলকারখানার যন্ত্রাংশ পাকিস্তানে পাচার করে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অর্থনীতি পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর সরকার পাট শিল্প উন্নয়ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। তার শাসনামলে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ এসেছে পাট থেকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দেড় যুগ ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাটের অবদানই ছিল মুখ্য। পাট চাষ এবং পাটপণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানির মাধ্যমে বাংলার মানুষের আর্থসামজিক উন্নয়ন ঘটে। অর্থকরী ফসল পাট চাষাবাদের এবং পাটজাত পণ্য উৎপাদনেন মধ্য দিয়েই এই দেশের গরিব চাষিরা অর্থের ছোঁয়া পায়। পাট বিক্রয়ের অর্থমূল্যে তাদের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে।
তবে ১৯৮০-এর দশকে কৃত্রিম তন্তু সহজলভ্যতা, সময়ের সাথে পাটকল আধুনিকায়ন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য উৎপাদন না হওয়ায় দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ও বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা হ্রাস পায়। সস্তা পলিথিন ও প্লাস্টিক এই স্থান দখল করে নেয়। এ সময় রপ্তানি আয়ে পাটশিল্পকে অতিক্রম করে পোশাকশিল্প প্রথম স্থানে চলে আসে। অফুরন্ত সম্ভাবনা এই খাত নির্মম অবহেলার শিকার হতে শুরু করে। আশির দশকের শুরুতে এদেশে কাঁচা পাটের উৎপাদন ছিল ৬০ থেকে ৬৫ লক্ষ বেল। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে এটি নেমে যায় ৪৪ থেকে ৪৭ লাখ বেলে। অপরদিক পাটকে কেন্দ্র করে দেশে যে শিল্প গড়ে উঠেছিল তা সংকটের মুখে পড়ে। পাটশিল্প নানান উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেলেও, এই গুরুত্বপূর্ণ খাতের সম্ভাবনার আলো বেশি দিন কালো মেঘে ঢাকা পড়ে থাকতে হয়নি, তা ফের উদ্ভাসিত হচ্ছে।
কেননা বর্তমানে পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সিনথেটিকের ব্যবহার পরিহার করে আবার জ্যামিতিক হারে বাড়ছে বিশ্বে পাটের ব্যবহার। পলিথিন ও প্লাস্টিক দুটি অপচনশীল রাসায়নিক দ্রব্য যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। পলিথিন বছরের পর বছর পড়ে থাকলেও পচে না। যা জমির উর্বরতা হ্রাস করে, সার ও পলিমাটি আটকে রাখে। নদী-খাল-বিলে পলিথিন স্তূপাকারে জমা হলে তার ওপর পলি পড়ে নদীর গভীরতা হ্রাস পায়। প্লাস্টিকের আগ্রাসন শিকার হয়ে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। এমনকি প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেললেও এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিস্তার নেই, যেটির ফলে বায়ুতে বিষাক্ত পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে। তাই প্রাণঘাতী এবং পরিবেশ ধ্বংসকারী পলিথিন ও প্লাস্টিকের বিকল্প খুঁজছে বিশ্ববাসী। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক তন্তু বহুমুখীকরণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছে এবং বর্তমানে নানা পণ্য উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। পাট এখন নিত্যপ্রয়োজন নানা ধরনের পণ্য তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশেও প্রচলিত পাটের বস্তা, ব্যাগ বা সুতা ছাড়াও তৈরি হচ্ছে নানার নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। শো-পিস, শপিং ব্যাগ, হ্যান্ড ব্যাগ, পর্দা, জিও টেক্সটাইল, টেবিল ম্যাট, ফ্লোর ম্যাট, মেয়েদের গহনা, ওয়ালমেট, স্যান্ডেল, বেড কভার, কুশন কভার, সোফা কভার, কার্পেট, ডোরম্যাট, শতরঞ্জি, ফতুয়া, দরজা-জানালার পর্দার কাপড়সহ ২৮৫ ধরনের পণ্য দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পাট থেকে পরিবেশবান্ধব ও পচনশীল পলিমার ব্যাগ উৎপাদন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বে গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাম্প, ইনস্যুলেশন শিল্পে, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিকস, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহূত হচ্ছে। শুধু পাটের আঁশ নয়, পাটকাঠি বা পাট পাতাও আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন পণ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।পাটকাঠি এত দিন গ্রামে রান্নার কাজে জ্বালানি ও ঘরে বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো। এখন পাটকাঠি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হচ্ছে উচ্চমূল্যের অ্যাক্টিভেটেড চারকোল বা ছাই, যা জ্বালানি হিসেবে এবং ফটোকপি মেশিনের কালি ও কাগজ তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। পাট পাতার হার্বাল চা, যা জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশ-বিদেশে সম্পসারিত হচ্ছে পরিবেশবান্ধব পাটপণ্য বাজার। অথচ দেশে ও বহির্বিশ্বে পাটপণ্যের বিপুল চাহিদা থাকার পরেও রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো এখনো লোকসান গুনছে। বাংলাদেশে নতুন ধরনের নানা পাটজাত পণ্য তৈরি শুরু হলেও বিশ্ব বাজারে ব্র্যান্ডিং এখনো দুর্বল। পাটের হারানো ঐতিহ্য পুরোপুরিভাবে ফিরিয়ে আনতে মানসম্মত পাট উৎপাদন, পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, পাটপণ্যের বহুমুখীকরণ ও পাটকলের আধুনিকায়ন জরুরি।
আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে পাট শিল্পের সুদিন ফিরতে শুরু করছে। করোনা মহামারির ধাক্কা যেখানে তৈরি পোশাক, চামড়া, হিমায়িত মাছসহ সব খাতেই রপ্তানি আয় কমছে, সেখানে একমাত্র ব্যতিক্রম পাট। জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়েও ৮ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। মহামারির কারণে পরিবেশের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসায় বিশ্বে পাটপণ্যের চাহিদা নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। এই সুযোগটি যদি আমরা নিতে পারি, তাহলে আমাদের এ খাতের রপ্তানি অনেক বাড়বে। বাংলাদেশ অবশ্যই পাট-শিল্পের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে।
মাহফুজুর রহমান
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়