সিরাজুল ইসলাম সোহাগ
প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ গণমাধ্যম এবং মৌলিক মানবাধিকারের মতো স্বতঃসিদ্ধ ইস্যুগুলো নিয়ে বরাবরই সোচ্চার পশ্চিমা বিশ্ব। বিশ্বব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে পশ্চিমা বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো নিরপেক্ষভাবে সংবাদ প্রচার করে থাকে বলে বিবেচনা করা হয়। তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো দেশে যখনই গণতন্ত্র, গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংকটাপন্ন হয় তখনই দেখা যায় পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো আন্তর্জাতিক সংগঠন, মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে আহ্বান জানায় বিপন্ন বিধ্বস্ত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের রূপরেখা প্রণয়ন করতে।
কিন্তু চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে ভিন্ন চিত্রপট লক্ষ করা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থী জমি দখল ও নিরীহ, নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বর আগ্রাসনকে বরাবরই বৈধতা দিয়ে আসছে পশ্চিমা বিশ্ব। বর্ণবাদ, জাতিগত নির্মূল ও দখলদারিত্বের পরিকল্পনার মাধ্যমে ইসরাইল বহু ফিলিস্তিনিকে তাদের ঐতিহাসিকভাবে প্রাপ্ত জমি থেকে উচ্ছেদ করে উদ্বাস্তু করেছে। ইসরাইলি বর্বর সামরিক বাহিনী যা সীমাহীন নির্যাতন ও নিষ্পেষণের মাধ্যমে এখনো চলমান রেখেছে। একই পরিকল্পনা ও নগ্ন সন্ত্রাসী আগ্রাসনের মাধ্যমে পুরো ফিলিস্তিন দখল করতে চায় ইসরাইল। সর্বশেষ পবিত্র আল-আকসা মসজিদের সন্নিকটে অবস্থিত আবাসিক এলাকা শেখ জাররাহর চার আরব পরিবারের উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে ইসরাইলি বাহিনী ও সাধারণ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনার মধ্যেই বহুসংখ্যক প্রাণহানি ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে।
এদিকে ইসরাইলি আগ্রাসন ও বর্বরতায় ফিলিস্তিনি নারী, শিশুসহ সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে গাজার আকাশ-বাতাস যখন প্রকম্পিত, বিশ্ববিবেক যখন প্রশ্নবিদ্ধ তখন পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো ইসরাইলি আগ্রাসন ও বর্বরতাকে বৈধতা দিতে অঘোষিত প্রতিযোগিতায় নেমেছে। মুহুর্মুহু ইসরাইলি বোমায় জনবসতিপূর্ণ গাজা যখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে, তখন রয়টার্স তাদের শিরোনাম করেছে ‘ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী সংগঠনের রকেট হামলা, দ্বিতীয় দিনের মতো ইসরাইলি বিমান হামলা চলমান’। এমনিভাবে পশ্চিমা বিশ্বের তথাকথিত স্বাধীন গণমাধ্যমগুলো বিকৃত ও অস্বচ্ছ তথ্য তুলে ধরে ইসরাইলিদের আত্মরক্ষার পক্ষে সাফাই গাইছে। একটি বিষয় খুব লক্ষ করার মতো যে, প্রায় সব পশ্চিমা গণমাধ্যম ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটকে কাভার করলেও মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে ফিলিস্তিনি একমাত্র স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ইসরাইলি বিমান হামলার প্রতিবাদস্বরূপ হামাসের রকেট হামলাকে সন্ত্রাসী ও সাধারণ ইসরাইলিদের ওপর অবৈধ হামলা হিসেবে প্রচার করলেও ইসরাইলি কামান গোলা ও বিমান হামলাকে আত্মরক্ষার কবচ হিসেবেই আখ্যায়িত করছে। অথচ কয়েকমাস আগে সংঘটিত ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস (কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনও মূল্যবান) আন্দোলনে তারা নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন তুলে মানবিকতার ধুয়া তুলেছিল, যা পশ্চিমা গণমাধ্যমসমূহের দ্বিমুখী নীতির প্রকৃষ্ট নিদর্শন।
সারা বিশ্বে ইসরাইলিদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য ও ইহুদি বিদ্বেষকে নির্মূল করার জন্য একাধিক ইসরাইলি লবি কাজ করে আসছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম ‘সারাহ হেলম’-এর এক প্রতিবেদক অভিযোগ করে বলেন, ‘আপনি যখন ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটের সংবাদ করবেন, তখন আপনার ওপর অবশ্যই একাধিক শক্তিশালী সূত্র থেকে চাপ আসবে।’ এছাড়াও সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলেই ইহুদি লবির প্রচার ও প্রকাশনার প্রভাব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক বিভিন্ন প্রো-ফিলিস্তিনি সূত্র থেকে অভিযোগ জানানো হচ্ছে যে, ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি, সহমত ও সংহতি সম্পর্কিত লেখাগুলো মুছে দেওয়া হচ্ছে এমনকি অনেক সময় ওইসব অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেওয়া হচ্ছে। ২০১৮ সালে ইসরাইলি বিচারমন্ত্রী প্রকাশ্য এসব টেক কোম্পানিগুলোর প্রশংসা করেন তাদের অনুরোধে ইসরাইলবিরোধী কন্টেন্ট মুছে দেওয়ার জন্য। দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের পক্ষপাতমূলক আচরণ কতটা বিধানসম্মত?
সংঘাত, সহিংসতা, দখলদারিত্ব কোনো আরব বা মুসলিম সম্পর্কিত বিষয় নয়। এটা পুরোপুরি মানবিকতার প্রশ্ন। আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় ভরপুর বিশ্বে গণমাধ্যমকে আত্তীকরণ না করে উপেক্ষা করার কোনো ভিন্ন পন্থা নেই। সমতাভিত্তিক বিশ্ব গঠনে গণমাধ্যমকে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা, দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা শুধু ন্যায্য, আত্মিক ও আইনসংগত দাবির মাঝে সীমাবদ্ধ নেই, তা এখন বিশ্বজনীন দাবি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সুতরাং বৈশ্বিকভাবে তার পক্ষে-বিপক্ষে সমর্থন উঠবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এক্ষেত্রে নীতি-ন্যায্যতা, বৈধ-অবৈধ ও মানবিকতা-অমানবিকতাকে বিচারের দণ্ড হিসেবে না ধরে একপক্ষীয় অবস্থান গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মানবতা কোনো কিতাবে ছাপা ধারণামাত্র নয়, ন্যায্যতার সমর্থন জানাতে না পারলে মানবতাও প্রশ্নবিদ্ধ-ভূলুণ্ঠিত হতে বাধ্য।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়