নাজমুল হাসান
রাজনৈতিক সংকটের চেহারাটা বহুমাত্রিক, যাকে কোনো নির্দিষ্ট ফ্রেমে বাঁধা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষে যেসব ঘটনা চলছে— সেগুলোকে রাজনৈতিক সংকট হিসেবে অভিহিত করা যেতেই পারে। গত তিন মাসে দল বদলের যে হিড়িক আমরা চোখ ছানাবড়া করে প্রত্যক্ষ করছি, তাতে এ কথা দ্বিধাহীনভাবে বলা চলে যে, পশ্চিমবঙ্গে যারা রাজনীতি করেন, তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক আদর্শের দিক দিয়ে একেবারে চরিত্রহীন হয়ে উঠেছেন। দেউলিয়া হয়ে পড়েছেন। সকালে একদল, বিকেলে একদল, সন্ধ্যায় আরেক দল। এই সপ্তাহে যাকে রাজনৈতিক গুরু মেনে তোয়াজ করছেন। পরের সপ্তাহে তার চৌদ্দপুরুষের শ্রাদ্ধ করতে অনেকের আদর্শে বাঁধছে না। মুখ তো কাঁপছেই না। রাজনৈতিক চরিত্রহীনতার এমন নজির আর কোথাও দেখা গেছে বলে স্মরণ করতে পারি না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মত পরিবর্তনের অধিকার থাকতেই পারে। কিন্তু সেই অধিকার যখন ব্যাপক সংখ্যক মানুষ আত্ম-স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন— তখন সেটি যারপরনাই নিন্দনীয় হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এই বিবমিষা উদ্দীপক চর্চাই বর্তমানে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে এটা বলা যেতেই পারে— ভারতের নির্বাচন কমিশনের একটি সিদ্ধান্তে আসা উচিত; দল বদল করে ভোটে দাঁড়াতে হলেও, একটি নির্দিষ্ট সময় সেই দলের সদস্য হিসেবে কাজ করতে হবে। নইলে দল বদলের এই স্বার্থবাজ চেষ্টা কোনোভাবেই রোখা যাবে না। এটিই রাজনৈতিক ঐতিহ্যে পরিণত হবে। এবং বড় আদর্শ কিংবা গণমানুষের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থই ভারতের রাজনীতির একমাত্র কথা হয়ে উঠবে।
পশ্চিমবঙ্গের এই রাজনৈতিক সংকটে মক্ষীরাণী হয়ে উঠেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি বিতর্কিত পায়ের চোট নিয়ে কদিন ধরে হুইল চেয়ারে সওয়ারী হয়েছেন। বলাই বাহুল্য, এই আদর্শহীন চর্চার দায় দুই দফার মুখ্যমন্ত্রী কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। সত্তরের দশকে তিনি নিজের রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন কংগ্রেস দিয়ে। মমতা প্রথম সাফল্য দেখিয়েছিলেন ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের তুল্য ঝানু পার্লামেন্টারিয়ানকে ভোটে হারিয়ে। পরের পনেরো বছর তার বিকাশের কাল। নব্বইয়ের শেষে কংগ্রেস ভেঙে করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগপর্যন্ত তিনশ টাকার শাড়ি পরা, দেড়শ টাকার বিদ্যাসাগরী চটিধারী, কালিঘাটের টালির ঘরের বাসিন্দা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মানুষের প্রতি আপাত প্রতিশ্রুত হিসেবেই দেখা গেছে। যে পার্টিতন্ত্র পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কায়েম হয়েছিল; তিনি ছিলেন তার প্রধান বিপরীত স্বর। অবশ্য এই সময়ের মমতাকে একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা ভাবারও অবকাশ নেই। সুবিধাটা তিনি ঠিকই বুঝতেন। লুটতেন রাজনৈতিক ফায়দা। সেই খায়েশেই একবার বিজেপি, একবার কংগ্রেসের কাঁধে সওয়ার হয়েছেন। কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়েছেন। দু’দফায় রেলমন্ত্রী হিসেবে তার কাজ বেশ প্রশংসাও কুড়িয়েছিল। এসব কাটিয়ে তার সবচেয়ে বড় কীর্তি ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটানো। যেখানে তিনি পরিবর্তনের স্লোগান তুলে মানুষকে মাতিয়েছিলেন। তবে আজ দশ বছর বাদে এটি স্পষ্ট যে— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্লোগানে অসততা ছিল। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম নিয়ে তুমুল আন্দোলনে তিনি যে প্রতিশ্রুতিগুলো মানুষকে দিয়েছিলেন; তার কিছুই মেটাতে পারেননি। ফলে তাকে সিপিএম নেতা গৌতম দেবের ভাষায় যদি বলা চলে : ‘ডিফরেন্ট টাইপ অব লায়ার’। তবে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামসহ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে তা সত্য। শাসক হিসেবে তিনি যে মূর্তি ধরেছেন— সেটি রীতিমতো বীভৎস। আদতে শহরের দালানকোঠার রঙ লাল থেকে নীলে বদল করা ছাড়া তিনি কোনো পরিবর্তনই করেননি।
দল বদল প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি তোপটা দাগাতে হচ্ছে এ কারণে যে— এই আদর্শহীনতা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তিনিই সবচেয়ে বেশি তোষণ করেছেন। বর্তমানে বিজেপির তুল্য একটি সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেই পাঁক ঘেটেও চলেছেন। মনে পড়ে, বছর দশক আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এখনকার মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় যখন কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন, তখনকার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি মানস ভুঁইঞাকে বলতে শুনেছিলাম : ‘এই এক মানুষ গিরগিটির মতো আর কতবার রঙ বদলাবে?’ এহেন আদর্শিক উক্তিধারী মানস ভুইঞাও এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই দলে। বলতে গেলে, মমতা এদের সবাইকে কিনেছেন টাকা দিয়ে। সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। এমনকি বাম নেতারাও আদর্শ বিকিয়ে দেদার লবণের মতো লীন হয়েছেন তৃণমূলের মুদিখানায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই নেতা ভাগানো চরিত্র তুলনীয় হতে পারে বাংলাদেশের সাবেক স্বৈরাচার এরশাদের সঙ্গে। এরশাদের আরেকটি গুণপনাও করায়ত্ত করেছেন মমতা। সেটি রাজনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিল্প-সাহিত্যের জগৎকেও দূষিত করা।
আমরা দেখেছি— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজগুবি সব ছড়ার বই লিখলেন। সরকারি খরচায় সেগুলো ছাপানো-বিকোনো হলো। কেবল তা-ই নয়, তুলি হাতে নিয়ে সবাইকে তাজ্জব করে মিনিটে মিনিটে একেকটা ছবিও আঁকতে লাগলেন। ধান্দাবাজ ব্যবসায়ীরা সরকারি সুবিধার লোভে কোটি টাকায় সেগুলো কিনলেন। এই টাকা গেল তৃণমূল কংগ্রেসের দলীয় তহবিলে। শিল্প-সাহিত্যকে ব্যবহার করে সরকারি দুরাচার, দুর্নীতির এমন নজির প্রকৃতই দুর্লভ। কেবল তা-ই নয়, তিনি হাত বাড়ালেন শিল্পী-সাহিত্যিকদের দিকেও। তাদের ব্যক্তিগত অর্জন ও জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করলেন রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে। বিনিময়ে দিলেন সুযোগ-সুবিধা। জয় গোস্বামী, শুভাপ্রসন্নের মতো চুনোপুঁটিদের কথা বাদ দিই। মমতার এই নষ্টামির সর্বোৎকৃষ্ট বলি হয়েছেন মহাশ্বেতা দেবী। মৃত্যুর আগে কেবল বুদ্ধি নয়, আদর্শও নাশ হয়েছিল প্রণম্য মহাশ্বেতার। রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্পর্শকাতর কবীর সুমনকে এখনো যখন মমতাকে নিয়ে প্রবল আবেগি ও ঢেলে দেওয়া ভাষায় ন্যাকামো করতে দেখা যায়— তখন ওর প্রতি কৃপা ছাড়া আর কিছু জন্মে না। সুমন টাকার কাছে বিকিয়েছেন তা বলি না। তবে হ্যাঁ, তিনি টকে গেছেন। তৃণমূলের হাঁড়িতে ধেনো মদের মতো টকে গেছেন সুমন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টালিগঞ্জের এমন সব নিম্নস্তরের অভিনেতাদের সাংসদ বানিয়েছেন; সংসদে যাওয়ার যোগ্যতা যাদের কোনো অর্থেই নেই। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, গীতা মুখোপাধ্যায়, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের তুল্য কিংবদন্তি সাংসদদের রাজ্যে এ এক সুবিপুল নষ্টামোরই নজির।
নব্বইয়ের শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেসের মাধ্যমে যে রাজনীতির শুরু করেছিলেন— তার অন্যতম একটি আদর্শিক ভিত্তি ছিল রাজনীতিকে পরিবারতন্ত্র থেকে বের করে আনা। অবিবাহিত, নিঃসন্তান মমতাকে দেখে মানুষের মধ্যে আস্থাও তৈরি হয়েছিল যে— তিনি কোনোভাবেই পরিবারতন্ত্রকে পরিপোষণ করবেন না। বলার অপেক্ষা রাখে না, ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পূর্ব অব্দি মমতা এই নীতি নিয়েই চলেছিলেন। ফলে— ব্যবহারিক অর্থে তৃণমূল কংগ্রেস যারা গড়ে তুলেছিলেন; সেই মুকুল রায়, শোভন চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারীরা হয়ে উঠেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছের মানুষ ও পরবর্তী নেতৃত্বের দাবিদার। দেখা গেল প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসেই মমতা ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করলেন। প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে হাস্যকরভাবে দলের দুটি যুব ইউনিট গড়লেন। যুব নেতা থেকে বর্তমানে তৃণমূলের ‘সেকেন্ড ম্যান’ অভিষেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অন্তহীন অভিযোগ। কেবল দুর্নীতিই নয়, দলের মধ্যে তিনি হয়ে উঠেছেন প্রবল কর্তৃত্বপরায়ণ। যে কারণে— পালে পালে নেতাদের দল ছাড়তে হচ্ছে। তাদের গন্তব্য বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অবস্থা এখন ‘খাজা বাবার ডেকচি’র মতো। আলু, পটল, বেগুন, মুরগি, ছাগল— পাত্রে সব ঢুকছে। অবশ্য সেই পাঁচমিশালি শিন্নির বেশিরভাগ উপাদান তৃণমূলের মুদিখানাই জোগাচ্ছে।
দলের এহেন ভাঙনের মুখেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিষেকের কর্তৃত্ব ছাঁটা দূরে থাক; বরং গ্রহণ করেছেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের নীতি। অপত্য স্নেহে সন্তানহীনা মমতা আজ অন্ধ। যে কারণে দলের অন্যতম মৌলিক নীতি জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি তাসের ঘরের মতো নিজের দল ভাঙা দেখে যাচ্ছেন। ইতিহাসের আরেকটি ট্র্যাজেডি হলো— মমতা যে দল ভাঙার কালচার শুরু করেছিলেন তার ফাঁদে নিজেই পড়েছেন। এমনকি তার দল থেকে টিকিট পাওয়ার পরও প্রার্থীরা বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। গত লোকসভা নির্বাচনের ফল ও বর্তমান রাজনীতির হাল দেখে বলা চলে— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এখন বিজেপি। যাদের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তিনিই এনেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির যে সমীকরণ দেখা যাচ্ছে— তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে এখন দুটি চ্যালেঞ্জ : প্রথমত নিজের দল টিকিয়ে রাখা। এটি করতে হলে দলের নেতৃত্ব সম্পর্কে তাকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হবে। বেরিয়ে আসতে হবে পরিবারতন্ত্রের ফাঁদ থেকে। দ্বিতীয়ত আসন্ন নির্বাচনে পুনরায় ক্ষমতায় আসা। বিজেপি তো আছেই। বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট মিলে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তাতে মমতার ক্ষমতায় ফেরাটা সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। ফলে এটি বলা যেতেই পারে, পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক ঝড়ো সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছেন, যা তার আগামীকে নির্ণয় করবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই পরিস্থিতি কতটা উতরে যেতে সক্ষম হন, এটিই এখন দেখার বিষয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক





