মুক্তমত

পলিব্যাগ ও প্লাস্টিক মানবসভ্যতার জন্য হুমকি

  • প্রকাশিত ৫ ডিসেম্বর, ২০২০

মোহম্মদ শাহিন

 

মানবসভ্যতা যতই অগ্রগতির দিকে ধাবিত হচ্ছে ততই আমরা কিছু অমীমাংসিত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়ছি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা তেমনি একটি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, এ সমস্যা যতটা না প্রাকৃতিক; তার চেয়েও বেশি মানবসৃষ্ট। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পলিব্যাগ ও প্লাস্টিক দূষণ।

সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডিও) প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পরিবেশের জন্য অন্যতম প্রধান হুমকি হিসেবে পলিব্যাগ ও প্লাস্টিককে চিহ্নিত করেছে। সংস্থাটি বলছে, পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর জেনেও দেশের ৬১ শতাংশ মানুষ পলিব্যাগ ও প্লাস্টিক ব্যবহার করছে।

আমাদের নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের মোড়কে প্রতিদিনই পলিব্যাগ ও প্লাস্টিক ব্যবহার করা হচ্ছে এবং ব্যবহারের পর বর্জ্য হিসেবে ড্রেন-রাস্তা-ঘাট, মাঠে-ময়দান, ডোবা, খালবিল এবং নদীনালায় ফেলা হচ্ছে। বিষাক্ত পলিব্যাগ ও প্লাস্টিক মাটিতে ফেলার দরুন মাটি হারাচ্ছে তার উর্বরতা। রাস্তা-ঘাট, নদীনালায় ফেলার দরুন সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতার, প্রভাব ফেলছে পয়ঃনিষ্কাশনে। একসময় পলিব্যাগ ও প্লাস্টিক পণ্যগুলো নদীনালা বেয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে পড়ছে সমুদ্রে। আর সমুদ্রের ঢেউ এবং সূর্যের আলোর প্রভাবে প্লাস্টিকের পণ্য ধীরে ধীরে টুকরো হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। পানি ও অন্যান্য খাদ্যের সঙ্গে একসময় এই মাইক্রোপ্লাস্টিক বিভিন্ন জীবের দেহে প্রবেশ করে। একসময় ফুড চেইন বিশেষ করে মাছের মাধ্যমে মানুষের শরীরেও প্রবেশ করে, যা মানবদেহে চরম স্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটায়। তাছাড়া ক্লোরিনযুক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে, যা ভূগর্ভস্থ ও ভূ-পৃষ্ঠীয় পানির সঙ্গে মিশে খাদ্যচক্রে ঢোকার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। অন্যদিকে পলিথিন ও প্লাস্টিক উৎপাদনে বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ভূমিকা রাখছে। ফলে জীব-বৈচিত্র্যের ওপরও ফেলছে মারাত্মক প্রভাব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পলিব্যাগ কিংবা প্লাস্টিকে মোড়ানো মাছ, মাংস, সবজি ইত্যাদি ব্যবহারে মানবদেহে ক্যানসারসহ বিভিন্ন জটিল রোগের সৃষ্টি হচ্ছে, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে হরমোন। যার ফলে দেখা দিতে পারে- বন্ধ্যাত্ব, নষ্ট হতে পারে গর্ভবতী মায়ের ভ্রূণ, বিকল হতে পারে লিভার ও কিডনি। সব মিলিয়ে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

সময় এসেছে আমাদের পলিথিন তথা প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ ব্যবহারে সচেতন হওয়ার। পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার যারা করছে, যত্রতত্র পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী না ফেলতে এবং এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে তাদের সচেতন করার বিকল্প নেই। ইতোমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে দেশের অবৈধভাবে পলিথিন ও প্লাস্টিক উৎপাদনের কারখানা ও সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছেন যা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে এর পাশাপাশি পরিবেশ অধিদপ্তর, ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং সিটি করপোরেশন থেকে পলিথিন ও প্লাস্টিক উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালন এবং জনগণকে সচেতন করতে হবে। পলিব্যাগ ও প্লাস্টিকের রিসাইকেলে সরকারকে অধিক মনোযোগী হতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিক জনসংখ্যা এবং অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশের মানুষ পলিব্যাগ ও প্লাস্টিকের ব্যবহার বেশি করে। সুতরাং এ ব্যাপারে টেকসই চিন্তা-ভাবনার বিকল্প নেই। পলিব্যাগ ও প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে সস্তা পরিবেশবান্ধব পণ্য উদ্ভাবন করতে হবে। সেক্ষেত্রে পাটজাত পণ্যের যথাযথ ব্যবহারে আমাদের হারানো সোনালি ঐতিহ্যও ফিরিয়ে আসবে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আমরা যদি প্রত্যেকে পলিথিনের পরিবর্তে পাটের ব্যাগ, প্লাস্টিকের জগের পরিবর্তে কাচের তৈজসপত্র, সিরামিকের কাপ এবং ঘর-গৃহস্থালিতে বাঁশ, বেত ও কাঠের তৈরি আসবাবপত্র ইত্যাদি ব্যবহারে গুরুত্ব দিই;  তাহলে এ সংকট থেকে অনেকটাই রেহাই পাওয়া সম্ভব। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বসবাসের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে আমাদের প্রত্যেকের উচিত পলিব্যাগ ও প্লাস্টিক ব্যবহারে সচেতন হওয়া।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads