পর্যটন : অমিত সম্ভাবনার বাংলাদেশ

ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্যের সমৃদ্ধতাই সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

পর্যটন : অমিত সম্ভাবনার বাংলাদেশ

  • প্রকাশিত ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি- এই গানের কলির মতো চিরন্তন সত্য বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা। সবুজ পাহাড়, গ্রামীণ জীবনের সরলতা, নদী, হাওর, সমুদ্রসৈকতসহ ঐতিহাসিক নিদর্শন, পুরাকীর্তি ও স্থাপনা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সভ্যতা, ঋতুবৈচিত্র্যের এত রঙ রূপ পৃথিবীর আরো কোনো দেশে নেই। ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্যের সমৃদ্ধতাই যেন পর্যটনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে এই শিল্পের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা জানাচ্ছেন এস এম মুকুল

বিশ্ব পর্যটন দিবস ও বিশ্ব প্রেক্ষিত

জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডব্লিউটিও) উদ্যোগে ১৯৮০ সাল থেকে জনসাধারণের মধ্যে পর্যটন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছরের মতো এবারো ২৭ সেপ্টেম্বর দিবসটি পালন করা হবে। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা যায়, একক শিল্প খাত হিসেবে বিশ্বের মোট জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের অবদান শতকরা ৯ ভাগ। বিশ্বের মোট চাকরি বা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখছে শতকরা ৮ ভাগ। বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে অবদান রাখছে শতকরা ৬ ভাগ, যার পরিমাণ ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত। পরোক্ষভাবে এই খাতে প্রায় ৮০ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

জানা গেছে, ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা প্রতি বছর থাকা, খাওয়া, ভ্রমণ, দর্শন ও কেনাকাটা বাবদ খরচ করেন প্রায় ৫০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার ২০১৮ ট্যুরিজম হাইলাইটস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালের পর ২০১৭ সালে বিশ্বে আন্তর্জাতিক পর্যটক গমন বেড়েছে ৭ শতাংশ, আয় ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা কমবেশি ১০০ কোটি, যা ২০২০ সালে ১৬০ কোটিতে উন্নীত হতে পারে বলে অনেকের ধারণা।  বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বে ২০২০ সাল নাগাদ পর্যটন থেকে প্রতি বছর ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হবে। বিশ্বের যেসব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটন খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তাদের মধ্যে ফ্রান্স, মিসর, গ্রিস, লেবানন, ইসরাইল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালি, থাইল্যান্ড, মৌরিতাস, বাহামা, ফিজি, মালদ্বীপ, ফিলিপাইন, সিসিলি অন্যতম। বর্তমানে বিশ্বের অর্ধেক পর্যটক যাচ্ছে ইউরোপে। তবে ২০৫০ সাল নাগাদ ৫১টি দেশের পর্যটক আমাদের দেশে আসবে। আশার ব্যাপারটি হলো, বিপুলসংখ্যক পর্যটকের মূল গন্তব্য হবে এশিয়ার দেশগুলো। কাজেই এই বিশাল বাজার ধরতে পারলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা।

অপার সম্ভাবনা বাংলাদেশের

পর্যটন একটি বহুমুখী শিল্প খাত। এই শিল্পটিরও অনেক শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত হয়েছে, যেমন- ঐতিহাসিক নিদর্শন, প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি, ধর্ম, স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, ব্যবসা-বাণিজ্য। পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল ১০টি পর্যটন কেন্দ্রের একটি হিসেবে ভাবা হচ্ছে। আমরা জানি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য পৃথিবীর অনেক দেশের অর্থনীতির নাড়ির স্পন্দনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়েছে পর্যটনকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশেও এ শিল্পের সম্ভাবনা অফুরন্ত। তাই এ শিল্পকে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পর্যটকরা এখন পুরাকীর্তি, বাংলো, বাগান, পাহাড়, সাগর, ঝরনার পাশাপাশি ইকো ট্যুরিজমের দিকে ঝুঁকছে। প্রকৃতির পাশাপাশি মানুষের বিচিত্র জীবনধারা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিও পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়ছে।  ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) ২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পে ১২ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, যা বাংলাদেশের সর্বমোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৮ ভাগ। পর্যটন শিল্পের জিডিপিতে প্রত্যক্ষ অবদানের ভিত্তিতে ১৭৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের অবস্থান ১৪২তম। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রায় আয় হয়েছে ৪ হাজার ১৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের মধ্যে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা আনুমানিক ১০ লাখে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১০ শতাংশ এই খাত থেকে আয় করা সম্ভব। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের মতে, ২০১৩ সালে পর্যটন খাতে ১৩ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এই খাতে ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। যদি তা সম্ভব হয়, তাহলে ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে পর্যটন খাতের অবদান দাঁড়াবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। পর্যটন সংশ্লিষ্টদের অভিমত, এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন করে বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ ও অনুকূল সুবিধা সৃষ্টি করতে পারলেই বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার থেকে বছরে কমপক্ষে ২০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করা সম্ভব।

নৌ পর্যটন : বাংলাদেশের নদীগুলোর অবস্থা করুণ হলেও বিশ্বের অনেক দেশেই এমন নদীবিধৌত ভূখণ্ড নেই। তাই আরামদায়ক ও পরিবেশ-প্রকৃতিবান্ধব পর্যটন হিসেবে রিভার ট্যুরিজম বা নৌ পর্যটনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর কথা ভাবা দরকার। রাঙামাটি, কাপ্তাই, বান্দরবান, খুলনা, বাগেরহাট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে নৌ পর্যটন জনপ্রিয়তা  পেতে পারে। আমরা জানি, শহরের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরো সুগম করা এবং পর্যটকদের বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টির লক্ষ্যে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যুক্ত করার জন্য খাল কেটে নদী এবং সাগরের পানি শহরের  ভেতর আনা হয়েছে। এসব কারণে ভারতের কেরালা, জম্মু কাশ্মির কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ও মরিশাসে নৌ পর্যটন জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পরিকল্পিত উপায়ে অগ্রসর হলে নৌ ট্যুরিজম আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠতে পারে।

হাওরাঞ্চলের পর্যটন : হাওরের সৌন্দর্যে বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের বিখ্যাত পর্যটকরা বিমোহিত হয়েছেন। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা হাওরকে ‘উড়াল পঙ্খির দেশ’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। আশার খবর হচ্ছে, হাওরাঞ্চলের আকর্ষণীয় স্থানগুলোর প্রতি ভ্রমণপিপাসুদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। শীতে কুয়াশাচ্ছন্ন হাওরে থাকে অতিথি পাখির অবাধ বিচরণ। বর্ষায় হাওরের ছোট ছোট দ্বীপের মতো বাড়িঘর। আমাদের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতেও হাওরের রয়েছে অনন্য অবদান। হাসন রাজা, উকিল মুন্সী, বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের হাত ধরে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে হাওরাঞ্চলের সঙ্গীতভান্ডার। হাওরাঞ্চলের হিজল-তমাল বন আকৃষ্ট করে সৌন্দর্যপিপাসুদের। দেশের সাতটি জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে গঠিত হাওরাঞ্চলে শীত-বর্ষায় হাওরের স্বতন্ত্র রূপ প্রকৃতিপ্রেমীদের দুর্নিবার আকর্ষণে টেনে নিয়ে যায় পর্যটকদের। এ কারণে বিশাল এই হাওর বাংলাকে কেন্দ্র করে আমাদের পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ হতে পারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সমাগমে। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা গেলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের এ হাওরগুলো দেশের অন্যতম পর্যটন ক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। খালিয়াজুড়ি, মোহনগঞ্জ, তেঁতুলিয়া, কিশোরগঞ্জ, নিকলী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, তাহেরপুর, মধ্যনগর, ভোলাগঞ্জ, টেকেরহাট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, জামালগঞ্জ- এসব জায়গায় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মাধ্যমে পর্যটকদের থাকা, খাওয়া আর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার। হাওর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করা খুবই জরুরি। হাওরাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য রাস্তা নির্মাণ, ডুবু সড়কসহ হাওরের অমসৃণ রাস্তায় চলাচলের উপযোগী মোটরসাইকেলের মতো তিন চাকার বিশেষ বাইক তৈরি করা প্রয়োজন- যাতে চালকসহ তিন-চারজন যাত্রী বহন করা যায়।

স্পোর্টস ট্যুরিজম : বাংলাদেশের স্পোর্টস ট্যুরিজম বিষয়ে এফবিসিসিআই স্ট্যান্ডিং কমিটি অন স্পোর্টস ট্যুরিজম আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বলা হয়, বাংলাদেশের স্পোর্টসকে যদি সত্যিকার অর্থে পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ হবে। এশিয়ান জার্নাল অন স্পোর্টস অ্যান্ড ইকোনমির একটি আর্টিকেল থেকে জানা যায়, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ক্রীড়া পর্যটনে এশিয়ায় এগিয়ে থাকা দেশগুলো হলো- ভারত ১১ শতাংশ, চীন ১০ শতাংশ, থাইল্যান্ড ৯ শতাংশ, কোরিয়া ৮ শতাংশ, মালয়েশিয়া ৭ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ৫ শতাংশ ও নেপাল ৪ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ অংশীদারত্ব ২ ভাগেরও নিচে। আমাদের গ্রামীণ খেলা নৌকাবাইচ, হা-ডু-ডু, লাঠিখেলা, বলী খেলাগুলো যদি বিশ্বে প্রচার করা যায়, তাহলে বাংলাদেশকে Truely Sports Loving Country হিসেবে বহির্বিশ্বে উপস্থাপন করা সম্ভব হবে।

ইসলামিক পর্যটন : ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের তাবরিজ শহরকে ২০১৮ সালের জন্য ইসলামিক পর্যটন রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা জানি, পর্যটন শিল্প প্রসারের লক্ষ্যে সৌদি সরকার পবিত্র ওমরাকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘ইসলামিক ট্যুরিজমে’র উদ্যোগ নিয়েছে। সৌদি সরকারের এমন উদ্যোগের সঙ্গে অনেকটাই একমত বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। বাংলাদেশে ধর্মীয় ট্যুরিজমের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বলে এক গবেষণায় দেখিয়েছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের শিক্ষক শারমিন সুলতানা। তার গবেষণায় বলা হয়েছে, মসজিদ, মন্দির ও গির্জা পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। একইভাবে বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমাও হয়। এটিও সুশৃঙ্খলভাবে করতে পারলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে নতুন জাগরণ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পর্যটনবিষয়ক ‘ট্যুরিজম স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট ২০১১-১২ (পাইলট) অব বাংলাদেশে’র এক জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের অর্থনীতিতে পর্যটন খাতের অবদান ১৬ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। বিভিন্ন পরিসংখ্যানের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে জানা গেছে, পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত হোটেল ব্যবসা, রেস্তোরাঁ ব্যবসা, পরিবহনসহ বিনোদন খাত থেকে এ আয় হচ্ছে। জিডিপিতে এই খাতের অবদান ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ৮ লাখ ১৫ হাজার মানুষ।

জানা গেছে, দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন ঘটছে পর্যটন শিল্প বিকাশের ফলে। বর্তমানে এ শিল্পে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটছে। কারণ একজন পর্যটক এলে চারজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। সে হিসাবে ১ লাখ পর্যটকের সুবাদে ৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এটি খুবই আশাবাদের দিক। 

পরিবেশবান্ধব পর্যটন শিল্প প্রয়োজন

পর্যটনের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালে বিশ্ব পর্যটন সংস্থার সম্মেলনে পরিবেশবান্ধব পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার জন্য একটি আন্তর্জাতিক খসড়া প্রস্তাব অনুমোদিত হয়, যা এজেন্ডা-২১ নামে পরিচিত। সুন্দর ও দূষণমুক্ত জলবায়ু পর্যটন শিল্পের অন্যতম উপাদান। কেননা পর্যটকদের ভ্রমণস্থান, গমন ও গমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই পর্যটন শিল্প জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, দূষণমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকায়ও পর্যটন শিল্পে ধস নেমেছে। আমাদেরও মনে রাখা দরকার, সিডরের কারণে সুন্দরবনের বিধ্বস্ত অবস্থা বাংলাদেশের পর্যটন অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য চাই সুন্দর, দূষণমুক্ত, গুণগত মানসম্পন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ।

অনিন্দ্য সুন্দরম বাংলাদেশ

বাংলাদেশের মতো ষড়ঋতুর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আমাদের আছে মনোরম পাহাড়, আছে নদী, আছে দিগন্ত বিস্তৃত ভাটি-বাংলার হাওর, সর্ববৃহৎ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, সেন্ট মার্টিন, টেকনাফ তো আছেই। আছে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, ময়নামতি বিহার, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মনোমুগ্ধকর পাহাড়ের চা বাগান আর আদিবাসীদের বিচিত্র জীবনধারা। এ ছাড়া আছে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, মাধবকুণ্ডের ঝরনা, ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প, রেশম শিল্প, খাদি শিল্প, জামদানি, টাঙ্গাইলের তাঁত, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমবাগান, বাংলার বিচিত্র পেশা, ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, স্বাধীনতা ও ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ভাস্কর্য ও স্থাপনা, চিরসুন্দর গ্রামীণ জনপদ, হাটবাজার, মেলা-কৃষ্টি-কালচার, কৃষক-কৃষাণির সংগ্রামী জীবন, বাংলা নববর্ষের উৎসব- এ সবকিছুই পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের টাঙ্গুয়ার হাওর পরিযায়ী পাখির জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য স্থান। এই জলাশয়টিকে জাতিসংঘের রামসার কর্তৃপক্ষ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে ২০০০ সালে স্বীকৃতি দিয়েছে। হাকালুকি হাওর এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ মিঠাপানির জলাভূমি। বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে আরো আছে— তিন পার্বত্য জেলা, নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়া, সোনাদিয়া, পতেঙ্গা, মৌলভীবাজার, মহেশখালী, চট্টগ্রামের ফয়’স লেক, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ অনেক স্থান, পাহাড়পুর বিহার, শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, রানী ভবানীর কীর্তি, বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির, গির্জা। আরো আছে ময়নামতি, রামসাগর, সোনারগাঁ, নাটোর, রাজবাড়ি, দীঘাপাতিয়া জমিদার বাড়ি, তাজহাট জমিদার বাড়ি, কক্সবাজারের বৌদ্ধমন্দির, ঢাকার লালবাগ দুর্গ, আহসান মঞ্জিল, গৌড় লক্ষণাবতী শহর, বাগেরহাটের অযোধ্যা মঠ ইত্যাদি। এসব স্থান ভ্রমণপিপাসু বিশ্ববাসীর কাছে আকর্ষণীয় এবং তাদের অবকাশ কাটানোর উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে। সমুদ্রসৈকতের কক্সবাজারকে এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন করে বিদেশি পর্যটক আনাসহ অনুকূল সুবিধা সৃষ্টি করতে পারলেই সমুদ্রসৈকত দুনিয়ার দ্বিতীয় দীর্ঘতম কক্সবাজার থেকে বছরে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করা সম্ভব। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি সুন্দরবন, সিলেটের দীর্ঘতম চা বাগান, পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই হ্রদ, সিলেটের জাফলং, মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত; নওগাঁ, নাটোর, দিনাজপুর, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও শেরপুরের প্রত্নসম্পদ। নওগাঁর পালযুগের গৌরব পাহাড়পুর, কুমিল্লার শালবন বৌদ্ধবিহার, পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙামাটি আর খাগড়াছড়ির গাছপালা, পাহাড়-জঙ্গল, ঝরনা আর মেঘের ভেলা, রাঙামাটির কাসালং, সাজেক, বাঘাইছড়ি, বরকল, বিলাইছড়ি, লংগদু, নানিয়ারচর, রাজস্থলী, চন্দ্রঘোনা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় শ্যামল বাংলার রূপলাবণ্য, নদীর দেশ চাঁদপুর, বরিশাল, পিরোজপুর আর ঝালকাঠিতে দর্শনীয় স্থানের পাশাপাশি আছে নদী ভ্রমণের অপূর্ব সুযোগ।

পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে সরকারের পরিকল্পনা

সমুদ্রসৈকতকে আরো আধুনিক নিরাপত্তায় বেষ্টিত করে, পর্যটকদের ভ্রমণসুবিধা বাড়িয়ে, সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজালে কক্সবাজার, টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন পাল্টে দিতে পারে পর্যটন শিল্পের চেহারা। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে সরকারেরও আছে নতুন পরিকল্পনা। সরকার ইতোমধ্যে সারা দেশে ৮ হাজার পর্যটন স্পট নির্ধারণ করেছে। কক্সবাজারের কলাতলী থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে টেকনাফ উপজেলায় সাবরাং নামক এলাকায় থাইল্যান্ডের পাতায়ার আদলে ‘সাবরাং পর্যটন অঞ্চল’ নামে এক হাজার ৪১ কিলোমিটারব্যাপী জায়গাকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন অঞ্চলে রূপ দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। সাবরাং পর্যটন পার্কে একাধিক আন্তর্জাতিক মানের হোটেল, রেস্টুরেন্ট, কটেজ, অডিটোরিয়াম, কনভেনশন হল, নাইট ক্লাব, বার, বিচ ভিলা, ওয়াটার ভিলা, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, কার পার্কিং, সুইমিং পুল, ল্যান্ডস্কেপিংসহ বিভিন্ন পর্যটন সুবিধা রাখা হবে বলে জানিয়েছে ইন্টার-এশিয়া।

সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা টেকনাফ নিয়ে নতুন করে ভাবছে সরকার। টেকনাফকে নিয়ে নতুন যে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, তার নামকরণ করা হয়েছে ‘প্রিপারেশন অব ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান অব কক্সবাজার টাউন অ্যান্ড সি বিচ আপ টু টেকনাফ’। দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে রেলওয়ের ভালো যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হলে কম খরচ ও সময় সাশ্রয় হবে। দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটারের রেললাইন খুলে দিতে পারে দেশের অর্থনীতির স্বর্ণদ্বার। পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক সুবিধা বাড়াতে পারলে পাল্টে যাবে অর্থনৈতিক চেহারা।

সম্ভাবনা কাজে লাগাতে করণীয়

দেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্যে বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক প্রচার ও উদ্যোগ। সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও শুধু প্রকৃতির দানের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে এর সুফল পাওয়া যাবে না। পরিকল্পনামতো মানুষের সৃজনশীলতায় সৃষ্ট স্থাপনা ও অবকাঠামোর সঙ্গে সমন্বয় ঘটাতে হবে। বাংলাদেশের সামগ্রিক পর্যটন অবকাঠামো আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে পৌঁছতে এখনো অনেক পথ বাকি। সুতরাং সরকারকে এই সম্ভাবনাময় শিল্প ব্যবস্থাপনার কথা গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে প্রয়োজন—

- পর্যটনকে বাণিজ্যিকভাবে গ্রহণ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় সুযোগ-সুবিধা দিলে পর্যটকরা অধিক হারে আকৃষ্ট হতে পারে।

- দেশের আনাচে-কানাচে অরক্ষিত ঐতিহ্যমণ্ডিত দর্শনীয় স্থানগুলোকে সুরক্ষিত করা হলে স্থানীয়ভাবে বহু লোকের নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

- শুধু বিদেশি পর্যটকদের নির্ভরতায় না থেকে ‘দেশকে চিনুন, দেশকে জানুন’; ‘ঘুরে দেখুন বাংলাদেশ- ভালোবাসুন বাংলাদেশ’  এ ধরনের দেশাত্মক স্লোগানে দেশের মানুষকে দেশ দেখানোর লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচার চালানো দরকার।

- মালয়েশিয়ার আদলে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বছরে একবার ‘স্কুল ট্যুরিজম’ বা শিক্ষা সফর আয়োজন বাধ্যতামূলক করা দরকার। এর ফলে প্রজন্মের সন্তানরা দেশকে চিনবে, জানবে, ভালোবাসবে। পাশাপাশি আয় হবে শতকোটি টাকা। 

- পর্যটন এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং ট্যুরিস্ট পুলিশ বাড়ানো দরকার।

- হাওর ট্যুরিজমকে জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

- পর্যটন শিল্প নিয়ে লেখালেখি ও ওয়ার্কশপ, সেমিনার, প্রদর্শনী বাড়ানো দরকার।

- পর্যটনবিষয়ক লেখালেখিকে উৎসাহিত করতে পর্যটন করপোরেশন পুরস্কার প্রবর্তন করতে পারে।

মোটকথা সার্বিক অবকাঠামোর উন্নয়ন ছাড়া পর্যটনের প্রসার ঘটানো কঠিন হবে। বিশ্বের কয়েকটি দেশ একমাত্র পর্যটনকে অবলম্ব্বন করেই সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করছে। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই বাংলাদেশে। আমাদের দেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঠিকমতো ও পরিকল্পিতভাবে করতে পারলে সুইজারল্যান্ড, পাতায়া, ব্যাংককের মতো ট্যুরিজম এখানেও গড়ে উঠতে পারে।

 

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads