নিরীহ সরীসৃপ প্রাণী গুঁইসাপ। গুঁইসাপের দেহ শুষ্ক এবং অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির। এর বাইরের আকৃতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গুটিতে আবৃত সমস্ত দেহ, উন্নত নখযুক্ত পাঁচ আঙুলের পা। অন্য সরীসৃপের তুলনায় নমনীয় দীর্ঘ গ্রিবা, অভঙ্গুর লেজ। গুঁইসাপের দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় থেকে তিন ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। গ্রামাঞ্চলে একসময় হামেশাই চোখে পড়া গুঁইসাপ এখন কদাচিৎ দেখা যায়। গুঁইসাপ খুব ভালো সাঁতারু।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শালবনের একাংশ রসুলপুর, সন্তোষপুর মধুপুর অংশের জঙ্গলের ঝোপঝাড়, বন-জঙ্গল বিনষ্ট, খাল-বিল, নদীনালা, পুকুর-ডোবা ভরাট, পরিবেশদূষণ ও মানুষের আক্রমণে পরিবেশের বন্ধু গুঁইসাপ হারিয়ে যাচ্ছে।
উদ্ভিদ ও প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, গুঁইসাপ প্রকৃতিবান্ধব প্রাণী। এদের সংখ্যা কমতে থাকলে পোকামাকড়, সাপ ও ইঁদুরের উৎপাত বেড়ে যাবে। কারণ গুঁইসাপ জীবিত বা মৃত প্রাণী খায়। বিষধর সাপ, ক্ষতিকর পোকামাকড়, ছোট সাপ, ব্যাঙ, ইঁদুর, মাছ, কেঁচো, শামুক, কাঁকড়া, হাঁস-মুরগির ছানা ও ডিম তাদের পছন্দের খাবার। বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রাণীদের মধ্যে গুঁইসাপ একটি।
বাংলাদেশে শুধু চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে গুইসাপের বিচরণ রয়েছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে রামগাদি বা বড় গুই (ঠধৎধহঁং ভষধাবংপবহং) প্রজাতির গুঁইসাপ রয়েছে। ২০০০ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) এই প্রজাতির গুঁইসাপকে বিলুপ্ত ঝুঁকিপূর্ণ প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। পরিবেশবিদদের মতে, বাংলাদেশে গুঁইসাপ ঝুঁকির অন্যতম কারণ চামড়া আহরণ এবং প্রজননক্ষেত্র এবং আবাসস্থল ধ্বংস। গুইসাপের চামড়া রফতানির ফলে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাবের বিবেচনায় ১৯৯০ সালে সরকার এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে এ প্রাণীটি সংরক্ষিত হলেও, অতিমূল্যবান চামড়ার জন্যই নিধন করা হচ্ছে এদের। সরকারি নিষেধাজ্ঞার পরও থামছে না গুইসাপের চামড়া পাচার। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণেই এই উপকারী প্রাণীটি আজ বিলুপ্তির পথে।
তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিশ্বে ৭৩ প্রজাপতির গুঁইসাপ রয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে মাত্র তিন প্রজাতির। অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গুইসাপের তিনটি প্রজাতি- কালো গুঁইসাপ (Varanus Salvator), সোনা গুঁইসাপ (Varanus Flvescens) ও রামগদি গুঁইসাপ (Varanus Bengalensis) কোনোরকমে টিকে আছে। বাংলাদেশে তিন প্রজাতির গুইসাপেরই বিচরণ রয়েছে, চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে। কিন্তু বন উজাড়, জমি, খাল-বিল পুকুর-ডোবা, ভরাট আর কুসংস্কারের কারণে গ্রামাঞ্চলে ভয় পেয়ে মেরে ফেলা হয় গুঁইসাপকে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গুইসাপের দেখা পাওয়া যায়। বিষধর সাপ ও ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে এরা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা মানবজাতির উপকার করে। কিন্তু মূল্যবান চামড়ার লোভে গুঁইসাপকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে, যার পরিণতি মানবজাতিকেই ভোগ করতে হবে।