পরিবর্তনশীল বিশ্বে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য

সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

পরিবর্তনশীল বিশ্বে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ১১ অক্টোবর, ২০১৮

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১৬ শতাংশ এবং শিশু-কিশোরদের মধ্যে ১৮ শতাংশ মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এ ছাড়া শিশু-কিশোরদের মধ্যে প্রতিহাজারে আটজন অটিজমে আক্রান্ত। এদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া রোগীর সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লাখ। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৮৯ লাখ ৫৭ হাজার ৭৪৫ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশের পূর্ণবয়সী মানুষের শতকরা ১৬ দশমিক ১ ভাগ মানসিকভাবে অসুস্থ। পুরো জনগোষ্ঠীর ওপর এই পরিসংখ্যান সত্য ধরে নিলে এখন দেশে আনুমানিক ২ কোটি ৭২ লাখ ২ হাজার ১৯৭ জন মানসিক রোগী আছে। তাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। দেশে ২০০ জনের মতো মানসিক রোগের ডাক্তার বা সাইকিয়াট্রিস্ট এবং ৪৫ জন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, ১৩৪ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, ৭৬ জন কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট, ৬৬ জন এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট, ২২ জন শিশু বিকাশ কেন্দ্রে কর্মরত চাইল্ড সাইকোলজিস্ট, ১৯২ জন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, ৬৪ জন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট, ২১০ জন ক্লিনিক্যাল সোশ্যাল ওয়ার্কার, ২০০ জন বিএসএমএমইউতে অনারারি ট্রেইনিং ইন সাইকোথেরাপি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাজীবী, ৫২ জন টিএ অ্যান্ড এনএলপি কাউন্সেলিং সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত কাউন্সেলর ও স্বল্পমেয়াদি কাউন্সেলিং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অজানা সংখ্যক কাউন্সেলররা রয়েছেন। মানসিকভাবে অসুস্থ এই বিপুল জনগগোষ্ঠীর সেবাদানে বিদ্যমান সেবাদাতার সংখ্য কত কম, তা সহজেই অনুমেয়।

মানসিক স্বাস্থ্য সপ্তাহ

১০ অক্টোবর ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার নেতৃত্বে ২০০৩ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। একই সঙ্গে ৭ থেকে ১৩ অক্টোবর পালিত হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য সপ্তাহ। বিশ্বজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এই দিবসটির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানসিক অসুস্থতার ব্যাপকতায় এই দিবস পালন জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য- ‘তরুণ সমাজের মানসিক সুস্থতা বদলাবে বিশ্ব’, খুবই সময়োপযোগী এবং প্রাসঙ্গিক।

দেশে প্রায় দুই কোটি মানসিক রোগী

ভাবতে অবাক লাগে, সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত। মানসিকভাবে অসুস্থ বিপুল এই জনগণের চিকিৎসার জন্য সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন হাসপাতালে মাত্র ৮১৩টি শয্যা রয়েছে। বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পৃথক কোনো সেবাকেন্দ্র নেই। হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওপর এ রোগের চিকিৎসা নির্ভরশীল। এ ছাড়া এ রোগের চিকিৎসার জন্য দেশে মাত্র ১৯৫ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। সরকারি পর্যায়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মানসিক রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সীমিত পরিসরে মানসিক রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।

শরীরচর্চায় মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি

দৈনিক অন্তত ৪৫ মিনিট করে সপ্তাহে তিন থেকে পাঁচবার শরীরচর্চা মানসিক সমস্যার সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, তবে এর চেয়ে বেশি ব্যায়াম করলে তা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হবে, এমন নয়। এই তথ্যটি জানা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায়। এতে বলা হয়, প্রতি দুদিনে ৩০ থেকে ৬০ মিনিট শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকাকে সবচেয়ে বেশি কার্যকর বলে মনে করা হয়। অতিরিক্ত ব্যায়ামে হিতে বিপরীত। আরো বলা হয়, সব বয়স ও লিঙ্গের মানুষই শরীরচর্চার ফলে মানসিকভাবে ভালো বোধ করেন। ঘরের কাজ করা ও শিশুদের দেখাশোনা করাও এই তালিকার মধ্যে পড়ে। যদিও শরীরচর্চা করলে হূদরোগ, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা কমে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে আগেই। তবে এই গবেষণায় অংশ নেওয়া প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা জানান, প্রতিমাসে গড়ে ৩-৪ দিন তারা মানসিকভাবে অপ্রসন্ন থাকেন। আর যারা শরীরচর্চা করেন তারা গড়ে প্রতিমাসে দু’দিন মানসিক বিষণ্নতায় ভোগেন। এই গবেষণা প্রতিবেদনটি ল্যান্সেট সাইকিয়াট্রি জার্নালে প্রকাশিত হয়। (সূত্র : বিবিসি বাংলা)

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য

আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা শারীরিক অসুস্থতাকে যতটুকু গুরুত্ব দিই, মানসিক অসুস্থতাকে ততটা দিই না। শরীরকে ভালো রাখার জন্য আমরা অনুশীলন করি, নিয়ম মেনে খাদ্যগ্রহণ করি। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যটা থেকে যায় অবহেলাতেই। অথচ একটা মানুষের শারীরিক সুস্থতা তখনই আসবে, যখন সে মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ থাকতে পারবে।

শিশুর মানসিক বিকাশ করে আলিঙ্গন

শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ভালোবেসে তাকে জড়িয়ে ধরা ও চুমু খাওয়া প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত পরিবার থেরাপিস্ট ভার্জিনিয়া স্যাটির বলেছেন, শিশুরা কোনো ভুল করলে তাদের যেমন বকা দেওয়া হয়, একইভাবে তাদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য দ্রুতই আলিঙ্গন করা এবং জড়িয়ে ধরাও প্রয়োজন। বড়দের মতো শিশুরাও মাঝে মাঝে অবসাদ অনুভব করে। তাদের এই হতাশা ও অবসাদ থেকে বের করে আনার জন্য জড়িয়ে ধরা ও চুমু খাওয়ার গুরুত্ব অনেক। এতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং তারা তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, শারীরিক সংযোগ শিশুর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে শৈশবে। শিশুর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য তাকে জড়িয়ে ধরা, চুমু খাওয়া ইত্যাদি বিষয় শিশুর ভালো অনুভূতির হরমোন নিঃসৃত করে, যা শিশুর বিকাশকে প্রভাবিত করে।

শিশু-কিশোর পরিস্থিতি

বিবিসি স্কুল রিপোর্টের গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা অর্ধেক কিশোর-কিশোরী মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ঘটনা একা একা সামলানোর চেষ্টা করে থাকে। তারা পর্যাপ্ত সাহস পায় না তাদের শিক্ষকের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে। কমরেসের গবেষকরা বিবিসি স্কুল রিপোর্টের জন্য ১০০০ জনের মধ্যে একটি জরিপ করে। জরিপটি করা হয় ১১ থেকে ১৬ বছরের কিশোর-কিশোরীদের ওপর। শতকরা ৭০ ভাগ কিশোর-কিশোরী গত এক বছরে নানা সময়ে নেতিবাচক অনুভূতির শিকার হয়েছে। দুঃখ অনুভব করেছে, অসুখী ছিল, উদ্বিগ্নতা, ভয় এবং নিরাপত্তার অভাব বোধ করেছে। শতকরা ৪৭ ভাগ দুঃখবোধ করেছে এবং অসুখী ছিল, শতকরা ৩৪ ভাগ চিন্তায় ছিল তারা দেখতে কেমন, শতকরা ৪১ ভাগ উদ্বিগ্নতায় ভুগেছে।

- সাইকোলজি টুডে অবলম্বনে ও বিবিসি বাংলা অবলম্বনে

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads