বিডিআর বিদ্রোহের নামে পিলখানায় স্মরণকালের জঘন্যতম সেনা হত্যাকাণ্ডের ১৩ বছর পূর্ণ হলো আজ। এদিন বিডিআর বিদ্রোহীরা তথাকথিত দাবিদাওয়া আদায়ের নামে ৫৭ জন মেধাবী ও চৌকস সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। একসঙ্গে এত সেনা কর্মকর্তা হত্যার ঘটনা বিরল। হত্যাকাণ্ড মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ১৫২ জনের রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে আর যাতে কোন বাহিনীতে এমন বিদ্রোহের ঘটনা না ঘটতে পারে, এজন্য নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ।
বিডিআর বিদ্রোহের পর বাহিনীটির নাম পরিবর্তন করে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) করা হয়েছে। বিজিবির নতুন আইনে বিদ্রোহের শাস্তি সর্বোচ্চ ৭ বছরের পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। বাহিনীকে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। বাহিনীতে প্রথমবারের মতো নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নারীদের। যারা সফলতার সঙ্গে সীমান্তের বিভিন্ন চেকপোস্টসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে দায়িত্ব পালন করছেন। আজ বিডিআর বিদ্রোহে শাহাদতবরণকারীদের শ্রদ্ধা জানাবেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনী ও বিজিবি প্রধানসহ ঊর্ধ্বতনরা। আজ ও আগামীকাল শনিবার শাহাদতবরণকারীদের স্মরণে বিজিবির প্রতিটি দপ্তরে বিশেষ দোয়া, মিলাদ মাহফিলসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
দরবার হল থেকে বিদ্রোহ শুরু : মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল বিডিআরের বার্ষিক দরবারের দিন। অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল নয়টায় সদরদপ্তরের দরবার হলে। সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, উপমহাপরিচালক (ডিডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ বারী, বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তাসহ বিডিআরের নানাপদের সদস্যরা। সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, ওই দিন দরবারে উপস্থিত ছিলেন ২ হাজার ৫৬০ জন।
দরবার শুরুর পর ডিজির বক্তব্য চলাকালে সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে মঞ্চের বাঁ দিকের পেছন থেকে দুজন বিদ্রোহী জওয়ান অতর্কিতে মঞ্চে প্রবেশ করেন, একজন ছিলেন সশস্ত্র। শুরু হয় বিদ্রোহ। দরবার হলের বাইরে থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যে লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধা বিদ্রোহী জওয়ানেরা দরবার হল ঘিরে গুলি শুরু করেন। ডিজি নিজে প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানসহ অন্যদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে দ্রুত সেনা হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্রোহী কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন। ডিজির নেতৃত্বে কর্মকর্তারা দরবার হলের বাইরে পা রাখা মাত্র মুখে কাপড় ও মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট পরা চারজন ডিজিকে লক্ষ করে ব্রাশফায়ার করেন। ডিজির পর হত্যা করা হয় আরো কয়েকজন কর্মকর্তাকে।
এরপর পিলখানার ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হলে ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন বিদ্রোহীরা। এ সময় প্রায় আধাঘণ্টা ধরে বিদ্রোহীরা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন। তারা মাইকে জানান, আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পিলখানায় আসতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে বিদ্রোহীদের নিরস্ত্রীকরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বেলা দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাদা পতাকা নিয়ে পিলখানার ৪ নম্বর ফটকের সামনে যান প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ১৪ সদস্যের বিডিআর প্রতিনিধিদলকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে নানক সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু সন্ধ্যা সাতটার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের দাবি করেন বিদ্রোহী জওয়ানেরা। তারা আগের মতো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করেন। সন্ধ্যায় পিলখানার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ মাটিতে পুঁতে ও সরিয়ে ফেলা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি বেলা আড়াইটায় টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারিত জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণ করে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে। এরপর বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ শুরু করেন।
বিস্ফোরক মামলার বিচার কত দূর : বিডিআরে বিদ্রোহের ঘটনায় দণ্ডবিধি ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়। এর মধ্যে হত্যা মামলায় হাইকোর্ট গত নভেম্বর মাসে রায় ঘোষণা করেন। কিন্তু ঢাকার আদালতে বিচারাধীন বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলার বিচার সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়ে গেছে। আদালত সূত্র নিশ্চিত করেছে, মামলার ১৩৪৫ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৫২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। এ মামলার বিচার নিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের অভিযোগ, রাষ্ট্রপক্ষ হত্যা মামলার বিচার নিশ্চিত করার জন্য যেমন উদ্গ্রীব ছিল এ মামলায় ততটা উদ্গ্রীব নয়।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম ও ফারুক আহম্মেদ বলেন, এ মামলার বিচার একেবার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এখন মাসে একবার শুনানির তারিখ পড়ছে। হত্যা মামলায় খালাস পাওয়ার পরও অনেক আসামি জামিন পাচ্ছেন না, যা অমানবিক। আদালতের কাছে বার বারই বিষয়টি তারা তুলে ধরছেন।
তবে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, এ মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ প্রতিটি শুনানির সময় সাক্ষী আদালতের কাছে উপস্থাপন করছে। আসামিপক্ষের আইনজীবীদের সহযোগিতা পাওয়া গেলে বিচার দ্রুত শেষ হবে। বিচার শেষ করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই।
হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ : এ মামলাকে ঐতিহাসিক রায় আখ্যায়িত করেন বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ। রায়ে আদালত পাঁচ দফা পর্যবেক্ষণ দেন। ১. বিডিআরের বিদ্রোহীরা পরস্পরের যোগসাজশে এবং অভিন্ন লক্ষ্যে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করেছেন, যার উদ্দেশ্য ছিল বিডিআরকে (বর্তমান বিজিবি) সেনা কর্মকর্তামুক্ত করা এবং বাহিনীতে নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ২. কোনো উসকানি, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, হতাশা বা ক্ষোভই পিলখানার ৫৭ জন চৌকস ও সম্ভাবনাময় সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার ন্যায্যতা দিতে পারে না। ৩. অপরাধের ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন ঘটনা। এই হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে জাতি কিছু প্রতিশ্রুতিশীল, উজ্জ্বল, সম্মানিত ও প্রতিভাবান সেনা কর্মকর্তাকে হারিয়েছে। এই ক্ষতি পূরণ হতে দীর্ঘ সময় লাগবে। বিডিআরের অবাধ্য বিদ্রোহীরা যে মাত্রায় নৃশংসতা দেখিয়েছে, তা কোনো সভ্য সমাজ মেনে নেবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার মাত্রা ছাড়িয়েছে। ৪. ঘটনা ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে এটাই বেরিয়ে আসে যে অভ্যন্তরীণ কিংবা বাইরের শক্তি নবগঠিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাত করতেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। ৫. এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য কোনো মহলের নীলনকশায় দেশে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করা এবং গণতন্ত্রের ধারাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা।
অপারেশন ডাল-ভাতের কার্যক্রম নেওয়া উচিত নয় : হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি সাত দফা সুপারিশ তুলে ধরেন। এগুলো হলো, ১. এটা আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা (পায়াস উইশ), অপারেশন ডাল-ভাতের মতো এমন কোনো কার্যক্রম নেওয়া উচিত নয়, যা বিজিবির সদস্যদের গৌরব ও আত্মসম্মানে আঘাত হানে। এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান যে এ ধরনের কর্মসূচি তাদের সৈনিকমূলক আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ২. অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যকার পেশাদারি সম্পর্ক বিজিবির আইন মোতাবেক হতে হবে। ৩. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিজিবি কর্তৃপক্ষকে বিজিবি সদস্যদের যেকোনো সমস্যা বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত সমাধান দিতে হবে। ৪. বিজিবির সদস্য ও কর্মকর্তাদের মধ্যে এখনো কোনো দুঃখ-দুর্দশা থাকলে বিজিবি কর্তৃপক্ষকে তা মিটিয়ে ফেলতে হবে। ৫. বিজিবির কোনো সদস্যের ভ্রমণ ভাতা ও দৈনন্দিন ভাতা এখনো বাকি থাকলে তা দ্রুত মিটিয়ে দিতে হবে। ৬. বিজিবি কর্তৃপক্ষকে তাদের অর্জিত ছুটি এবং এ-সংক্রান্ত সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। ৭. বিডিআরের রাইফেল সিকিউরিটি ইউনিট কেন বিডিআর হত্যাযজ্ঞের আগে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন এবং প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য বিজিবি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছেন আদালত।
বিজিবির কর্মসূচি : তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তর, পিলখানায় সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকান্ডে শহীদ ব্যক্তিবর্গের স্মরণে শাহাদৎ বার্ষিকী পালিত হবে। দিনের কর্মসূচি অনুযায়ী শহীদ ব্যক্তিবর্গের রুহের মাগফেরাতের উদ্দেশ্যে পিলখানাস্থ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদরদপ্তরসহ সকল রিজিয়ন, প্রতিষ্ঠান, সেক্টর ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় খতমে কোরআন, বিজিবির সকল মসজিদ এবং বিওপি পর্যায়ে শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় সকাল ৯টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধানগণ (সম্মিলিতভাবে), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক (একত্রে) শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এছাড়া দিবসটি পালন উপলক্ষে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর সকল স্থাপনায় বিজিবি পতাকা অর্ধনমিত থাকবে এবং বিজিবির সকল সদস্য কালোব্যাজ পরিধান করবে। এছাড়া বিজিবির সকল সেক্টর ও ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে বিশেষ দরবার অনুষ্ঠিত হবে। বাদ জুম্মা পিলখানাস্থ বিজিবি কেন্দ্রীয় মসজিদ, ঢাকা সেক্টর মসজিদ এবং বর্ডার গার্ড হাসপাতাল মসজিদে শহীদ ব্যক্তিবর্গের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
উক্ত দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে বিজিবি কেন্দ্রীয় মসজিদে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ, শহীদ ব্যক্তিবর্গের নিকটাত্মীয়গণ, পিলখানায় কর্মরত সকল অফিসার, জুনিয়র কর্মকর্তা, অন্যান্য পদবির সৈনিক এবং বেসামরিক কর্মচারীগণ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অংশগ্রহণ করবেন।