নীরব কান্না থামছেই না

প্রতীকী ছবি

জাতীয়

ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ

নীরব কান্না থামছেই না

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১০ জানুয়ারি, ২০২০

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকা আসছিলেন আইরিন খাতুন। তিনি স্বামী সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা খোরশেদুল ইসলাম ও দুই মেয়ে নিয়ে জেলা শহরের ফুলবাড়িয়ায় বাস করেন। পথে কিশোরগঞ্জের ভৈরব অংশে পাথর ছুড়ে মারে যে কেউ। যা ট্রেনের জানালা দিয়ে ঢুকে দেয়ালে আঘাত হেনে এসে পড়ে আইরিনের চোখে। পরের বিষয়টি অনেক ঝড়-ঝাপটার। আজীবন তিনি চোখহীন। একটি পাথর বসানো হয় তার চোখে। এ ছাড়া তার চিকিৎসায় মধ্যবিত্ত পরিবারটি অনেক ভোগে।

ট্রেনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন এহেছানুল হক ও সাবরিনা চৌধুরী দম্পতি। কুমিল্লার আখাউড়া স্টেশনে পৌঁছার আগে তাদের আসনের পাশের জানালা ভেঙে কাচের টুকরো শরীরে আঘাত করে। এসময় দুজনই আহত হন। পরে যাত্রীদের সহায়তায় অনেকটা আতঙ্কের মধ্যে চট্টগ্রাম পৌঁছেন তারা।

২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা এটি। এহেছানুল হক রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা। চট্টগ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার সময় ঘটনাটি ঘটে। তিনি বলেন, ওইদিন বিকেল তিনটায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেই। ট্রেনটি কুমিল্লার কাছাকাছি পৌঁছার আগে ঘুম আসে দুজনের। সাবরিনা জানালার পাশে বসেছিল। এমন সময় পাথর নিক্ষেপের ঘটনা। সে এত ভয় পেয়েছিল যে, এখন আর জানালার পাশে বসতে চায় না। তিনি প্রশ্ন রাখেন, যারা পাথর ছুড়ে মারছে, তারা কি মানুষ?

সিলেট থেকে ট্রেনে করে ঢাকা ফিরছিলেন মুনমুন চৌধুরী। খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এমন সময় তার আসনের পাশের জানালা ভেঙে কাচের টুকরো মুখে, শরীরে আঘাত করে। যাত্রীদের সহায়তায় রক্ত আর শরীর থেকে কাচের টুকরো সরাতে পারলেও বাকি পথটুকু ঢাকায় পৌঁছান আতঙ্ক নিয়ে। তিনি বলেন, এত ভয় পেয়েছিলাম যে এরপর থেকে আমি আর ট্রেনের জানালার কাছে বসতে পারি না। অকারণে কোনো অমানুষ ছাড়া কারো পক্ষে এভাবে ট্রেনে ঢিল ছোড়া সম্ভব নয়।

ওপরের তিনটি চিত্রের মতো অসংখ্য ঘটনা সারা দেশের ট্রেনলাইনে চলছে। কিছু অসুস্থ মানসিকতার মানুষ এসব করছে এবং কিছুটা তৃপ্তি পাচ্ছে। বিপরীতে অসংখ্য পরিবারে নেমে আসছে নীরব কান্না। চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোড়ার এমন ঘটনার পেছনে কারণ কী; তা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। মনস্তাত্ত্বিকরা বলছেন, কিছু মানুষ থাকে যারা অন্যের অনিষ্ট করে সাময়িক শান্তি পায়। পাথর ছোড়া এমনই মানুষের কাজ।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে কুমিল্লার গোমতী ব্রিজ এলাকায় সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় ৪ যাত্রী আহত হন। এর আগে ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে ছোড়া ঢিল থেকে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যায় ১৩ মাস বয়সী শিশু।

ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনায় যাত্রীর মৃত্যুও হয়েছে। সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারি এলাকায় ২০১৩ সালে চলন্ত ট্রেনে ছোড়া ঢিলে প্রকৌশলী প্রীতি দাশ নিহত হন।

রেলওয়ে সূত্রমতে, পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল মিলিয়ে ৮০টি এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখান থেকে ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটছে। এরমধ্যে পূর্বাঞ্চলের ৫টি জেলার ২০টি এলাকায় ৩৬টি স্পট খুব ঝুঁকিপূর্ণ, যেখান থেকে প্রায় সময় পাথর ছোড়া হয়।

সূত্রমতে, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে পূর্বাঞ্চলে ৮টি পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে নথিভুক্ত হয়েছে ৪টি। এই চারটি ঘটনায় ট্রেনের ক্ষতি হয়েছে। তবে এর বাইরেও যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো নথিভুক্ত হয়নি।

জিআরপি সূত্রমতে, ট্রেনে পাথর ছোড়ার যেসব ঘটনা ঘটছে তার সঙ্গে জড়িত ৮০ ভাগই শিশু-কিশোর। যারা বিভিন্ন বস্তি এলাকায় বেড়ে উঠেছে। এতে প্রায়ই যাত্রীরা গুরুতর আহত হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ট্রেনেরও। বস্তির এসব শিশুকে আটক করা হলেও বেশিরভাগ সময় মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারায় ট্রেনে পাথর ছুড়লে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। পাথর ছোড়ায় যদি কারো মৃত্যু হয়, তাহলে ৩০২ ধারায় দোষীর মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে। তবে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় শিশু ও কিশোররা জড়িত থাকায় তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো হয়। এ আইনে এখন পর্যন্ত কারো শাস্তির নজির নেই বলেই জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) ওসি মোস্তাফিজ ভূঁইয়া বলেন, চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে একসময় পাথর ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটলেও এখন এরকম ঘটনা নেই। পাহাড়তলীতে পাথর ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটার পর কয়েকবার অভিযান চালানো হয় এবং স্থানীয়দের সঙ্গে বৈঠক করার ফলে পাথর ছোড়ার ঘটনা কমে এসেছে। ওসি মোস্তাফিজ ভূঁইয়া বলেন, পাথর নিক্ষেপে জড়িত ৮০ ভাগই বস্তির শিশু-কিশোর। এ ছাড়া অনেকে দুষ্টুমির ছলেও পাথর নিক্ষেপ করে। প্রেম বিরহে এক যুবকের সিলেটগামী ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। তাকে আটকও করেছিলাম। তিনি বলেন, ‘যারা পাথর নিক্ষেপ করে তাদের চিহ্নিত করাও চ্যালেঞ্জ। প্রায় সময় তাদের চিহ্নিত করা যায় না। তাই তাদের আইনের আওতায়ও আনা যায় না।’

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম বলেন, পাথর নিক্ষেপের ফলে ট্রেনে যাত্রী আহত হওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্পদও নষ্ট হচ্ছে।

রেলওয়ে নিরাপত্তাবাহিনীর (আরএনবি) পরিদর্শক আমান উল্লাহ আমান বলেন, পাথর নিক্ষেপ তখনই বন্ধ হবে যখন মানুষ সচেতন হবে। আমরা প্রতি সপ্তাহে কয়েকবার ঝুঁকিপূর্ণ স্পটে গিয়ে পাথর নিক্ষেপ প্রতিরোধে প্রচারণা চালাচ্ছি। এলাকার মানুষজনকে সচেতন করছি।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা এখন খুব বেশি জোর দিয়েছি পাথর নিক্ষেপ প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করার কাজে। পুলিশ, নিরাপত্তাবাহিনী ও রেলওয়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া আছে, প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মানুষকে সচেতন করার। এ ছাড়া চিহ্নিত এলাকায় পুলিশের টহল বৃদ্ধি করেছি। পুলিশ আগের চেয়ে বেশি টহল দিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমরা লিফলেট তৈরি করে সেগুলো প্রচার করছি। মানুষের জীবন নিয়ে যারা খেলা করছে, আমরা তাদের সতর্ক করছি। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি এর ভয়াবহতা সম্পর্কে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গত বছরের ৭ মে একটি বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতিতে তিনি ট্রেনে পাথর নিক্ষেপকারীদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তরের আহ্বান জানান। মন্ত্রী বলেন, দুষ্কৃতকারীরা চলন্ত ট্রেনে ঢিল মেরে নিরাপদ বাহনকে অনিরাপদ করে তুলছে। এতে ট্রেনের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি মানুষের জীবনও বিপন্ন হচ্ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads