সম্পাদকীয়

মরণোত্তর চক্ষুদান

নিজ চোখে অপরকে পৃথিবী দেখাই

  • প্রকাশিত ৬ নভেম্বর, ২০২০

আব্দুর রউফ

 

 

শরীরের প্রতিটা অঙ্গই মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনো অঙ্গহানি হলে সেই অঙ্গের গুরুত্ব বোঝা যায়। তবে এই পৃথিবী উপভোগ করার জন্য চোখের গুরুত্ব অপরিসীম। ধরণির আলো, রং, রূপ আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে ধরা দেওয়ার জন্য যে অঙ্গটি সবচেয়ে জরুরি সেটা হলো চোখ। দৃষ্টিহীন মানুষের মতো অভাগা মানুষ পৃথিবীতে আর হয় না। দৃষ্টিহীন সেই মানুষের অন্ধকারের সেই কষ্টের কথা হয়তো দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের অনুভবের বাইরে। আগেকার দিনে দৃষ্টিহীনরা অন্ধত্বকে সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ বা ভাগ্যের লিখন বলেই মেনে নিত। তবে এখন সময় পাল্টেছে, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক ধরনের অন্ধত্ব রোধ করা যায়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সুবাদে অনেক অন্ধ মানুষ এই পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ পাচ্ছে।

কিন্তু কোনো দুর্ঘটনায় অন্ধত্বের ক্ষেত্রে অন্যের চোখ দিয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আর কোনো অন্ধ ব্যক্তিকে মরণোত্তর চক্ষুদান হলো মৃত্যুর পর কর্নিয়া দান করার জন্য জীবিত অবস্থায় অঙ্গীকার করা। মৃত ব্যক্তির চোখের কর্নিয়া সংগ্রহ করে অন্যজনের চোখে লাগানোর ইচ্ছা ও সম্মতিই ‘মরণোত্তর চক্ষুদান’ নামে পরিচিত। কর্নিয়া হলো চোখের সামনের স্বচ্ছ অংশ, যার মাধ্যমে আলো চোখের মধ্যে প্রবেশ করে। যদি কোনো কারণে চোখের কর্নিয়া অস্বচ্ছ হয়ে যায়, তাহলে ওই চোখে আলো প্রবেশ করতে পারে না। ওই চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। এ অবস্থাকে কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব বলা হয়।

বাংলাদেশে কর্নিয়াজনিত কারণে অন্ধত্বের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বর্তমানে দেশে কর্নিয়াজনিত কারণে অন্ধরোগী পাঁচ লক্ষাধিক, যার বেশির ভাগ আবার অল্পবয়স্ক। চোখ হলো একজন মানুষের সৃষ্টিকর্তার থেকে পাওয়া সর্বোচ্চ আশীর্বাদ এবং শ্রেষ্ঠ উপহার। দৃষ্টিশক্তি হারানো ব্যক্তি কর্মক্ষমতা হারানোর ফলে নিজ পরিবার এবং সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। শারীরিক ভাবে সক্ষম হওয়ার পরও শুধু অন্ধ হওয়ার কারণে সেই মানুষটি অসম্পূর্ণ জীবন বয়ে বেড়ায়। শতরকম কটুকথা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে অন্যের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয়। যে দুঃখটা হয়তো একজন দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দশ বছরে কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব দূর করতে প্রতি বছর ৩৬ হাজার কর্নিয়া সংগ্রহ করা প্রয়োজন। বর্তমানে দেশের মোট মৃত ব্যক্তির ২% কর্নিয়া সংগ্রহ করতে পারলেই কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব দূর করা সম্ভব। শুধু প্রয়োজন সচেতনতা এবং সদিচ্ছা। মরণোত্তর চক্ষুদান প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে হয়। চক্ষুদাতা এবং চক্ষুগ্রহীতার মাঝে কোনো প্রকার আর্থিক লেনদেন হয় না। বাংলাদেশে একমাত্র ‘সন্ধানী চক্ষুদান সমিতি’-এর চক্ষু গ্রহণ এবং বিতরণের অনুমোদন রয়েছে।

বাংলাদেশের আইন এবং ধর্মীয় বিধান মতে, মানব দেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন ২০১৮ সালের ৫নং আইনের ধারা-৫ মোতাবেক ‘চক্ষু বিযুক্তকরণের ক্ষেত্রে মৃতদেহ অন্য ব্যক্তির নিকট বা প্রতিষ্ঠান বা স্থানে থাকিলে উক্ত ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান বা স্থান যে জেলা প্রশাসকের প্রশাসনিক এখতিয়ারাধীন তিনি বা ক্ষেত্রমতো, তাহার নিকট হইতে এতদুদ্দেশ্যে লিখিতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি অনুরূপ বিযুক্তির জন্য লিখিত অনুমতি প্রদান করেন।’ সুতরাং বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন মোতাবেক যে কোনো ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় কিংবা মৃত্যুর পর তার আইনানুগ নিকট আত্মীয়ের অনুমতি সাপেক্ষে মরণোত্তর চক্ষুদান বিধিসম্মত। এরই মধ্যে সন্ধানী চক্ষুদান সমিতির মাধ্যমে মরণোত্তর চক্ষুদান করার মৌখিক অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

১৯৬৬ সালে মিসরের সর্বোচ্চ মুফতি প্রথম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দানের এবং ১৯৭৯ সালে সৌদি আরবের রিয়াদে আলেমদের সর্বোচ্চ কাউন্সিল চিকিৎসার প্রয়োজনে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান এবং প্রতিস্থাপনের পক্ষে ফতোয়া জারি করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৫ সালে সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে অনুষ্ঠেয় মুসলিম লীগের ফিকাহ্ একাডেমির ৮ম সভায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান ও প্রতিস্থাপন ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলে মতামত প্রদান করে। ১৯৮৬ সালে জর্ডানের আম্মানে অনুষ্ঠেয় অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কাউন্সিলের ফিকাহ্ কাউন্সিলের সভায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দানের সপক্ষে (জীবিত এবং মৃত্যুর পর) আদেশ জারি করে (আদেশ নং-৩/০৭/৮৬)। ফলে সিরিয়া, মিসর, মরক্কো, তিউনিশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশে বিশেষ করে আলেমদের অংশগ্রহণে চক্ষুদানের মহৎ ধারা ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে। এই দিকে ওআইসি মরণোত্তর চক্ষুদানকে অনুমোদন দিয়েছে। মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে দিন দিন মরণোত্তর চক্ষুদান জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ইসলাম ধর্মের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মেও মরণোত্তর চক্ষুদানের কোনো বিধিনিষেধ নেই।

সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, মরণোত্তর চক্ষুদান একটি মহৎ সেবা। মরণোত্তর চক্ষুদান ক্ষুদ্র মানবজীবনকে করে তোলে তাৎপর্যপূর্ণ।  মৃত্যুর পরও অনন্তকালের সৌন্দর্য উপভোগ করার, আরেকটা জগৎ আলোকিত করে তোলার মহৎ ক্ষমতা চক্ষুদানের। এতে কোনো কাটাকাটি ও রক্তপাত নেই। চেহারা বিকৃতির কোনো আশঙ্কাও নেই। তারপরও মৃত ব্যক্তির কর্নিয়ার স্থানে সিনথেটিক একটা পর্দা লাগিয়ে দেওয়া হয়, যাতে কোনো অবস্থায়ই বোঝা সম্ভব না হয় যে চোখের পর্দা দান করা হয়েছে। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি মাত্র কয়েক মিনিটেই সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। তাই এই সেবাকে সবার মাঝে পৌঁছে দিতে যেমন প্রয়োজন সচেতনতা, পাশাপাশি দরকার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। যে আন্দোলনের মাধ্যমে মরণোত্তর চক্ষুদানের ব্যাপারে জনমনে যত সংশয় আছে তা দূর হয়। তাই নিজে সচেতন হয়ে অন্যকে সচেতন করতে হবে। তাহলেই অন্ধ ব্যক্তিটি ফিরে পাবে দৃষ্টি।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads