ধর্ম

নারীর বন্ধু মহানবী (সা.)

  • প্রকাশিত ৮ জানুয়ারি, ২০২১

উবায়দুল হক খান

 

 

 

আমাদের নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল। কোরআন মাজিদে বর্ণিত তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ উপাধি হচ্ছে ‘রাহমাতুল লিল আলামীন’ (সৃষ্টির প্রতি দয়ার প্রতীক)। দয়ার সাগর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বিচার এলো অমুক তার স্ত্রীকে থাপ্পড় মেরে মুখ ফেটে দিয়েছে। মহিলাটির মুখের অবস্থা দেখে তিনি বললেন, তুমিও থাপ্পড় মেরে তার মুখ ফেটে দাও। নবীজি এ কথা বলার সাথে সাথে মহান আল্লাহ জিবরাইল (আ.)-কে দিয়ে ওহী পাঠালেন। ‘পুরুষেরা নারীদের ওপর কর্তৃত্বশীল। তা এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের কতককে (পুরুষকে) কতকের (নারীদের) ওপর (জাতিগতভাবে) শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং এ কারণেও যে, তারা (পুরুষেরা) তাদের সম্পদ (নারীদের জন্য) ব্যয় করে। অতএব, সৎ নারী তারাই, যারা আনুগত্যপরায়ণ ও পুরুষদের অনুপস্থিতিতে তাদের অধিকার (সম্পদ ও সম্মান) রক্ষাকারী। যেমনিভাবে আল্লাহ রক্ষা করেছেন তাদের (নারীদের) অধিকার (অন্ন-বস্ত্র-মোহর)।’ (সুরা আন নিসা, আয়াত- ৩৪) তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আমার ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছার অনুকূল হয়নি।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাধ্য হয়ে তোমাদের কাউকে তার স্ত্রীকে যদি মারতেই হয়, তাহলে মুখমণ্ডলে কখানো মারবে না। তোমার চেহারা আল্লাহ কুৎসিত করুক, এ দোয়া করবে না। আর অতি জোরে মারবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘তোমাদের কেউ তার স্ত্রীকে মারতে উদ্যত হয়ে তাকে গোলামের মতো মারে। কিন্তু (তার চিন্তা করা উচিত) হতে পারে, দিনের শেষে সে আবার তার সাথে শয়ন করবে।’

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, ‘তোমরা (আমার কাছ থেকে) নারীদের সাথে সদ্ব্যহারের নির্দেশনা গ্রহণ করো। কারণ, তারা তোমাদের কাছে আবদ্ধ। তোমরা তাদের কাছ থেকে (দৈহিক) সুযোগ-সুবিধা লাভ করা ছাড়া অন্য কিছুর মালিক নও। তবে যদি তারা প্রকাশ্য মন্দ কাজে (অর্থাৎ, স্বামীর প্রতি বিদ্রোহে) লিপ্ত হয়, তাহলে ভিন্ন কথা। যদি তারা এরূপ করে, তাহলে শয়নস্থল থেকে তাদেরকে পৃথক করে দাও এবং তাতে না হলে হাল্কাভাবে প্রহার করো। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়ে যায়, তবে তাদের বিরুদ্ধে (তালাক বা অন্য কোনো কষ্ট দিতে) পথ খোঁজো না। শোনো! স্ত্রীদের ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদের ওপরও তাদের অধিকার রয়েছে। তাদের ওপর তোমাদের যে অধিকার রয়েছে, তাহলো, তারা তোমাদের অপছন্দনীয় ব্যক্তিকে তোমাদের বিছানায় বসতে দেবে না এবং তোমাদের অপছন্দনীয় ব্যক্তিকে তোমাদের গৃহে প্রবেশের অনুমতি দেবে না। আর তোমাদের ওপর তাদের যে অধিকার রয়েছে, তাহলো, তোমরা তাদের বস্ত্র ও খাবারের সাধ্যমতো ব্যবস্থা করবে। (সুনানুত তিরমিযি, হাদিস নং-৩০৮৭)

এখন যদি কোনো মূর্খ বা কুশিক্ষিত বা কোনো কলমজীবী বা কোনো চোরাগোপ্তা লম্পট আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এ অপবাদ দেয়, তিনি নারী অধিকারের যথাযথ স্বীকৃতি দেননি। তাহলে মনে করতে হবে এসব লোকের হয়তো বউ নেই, বা বউয়ের প্রতি তাদের কোনো ভালোবাসা ও চাওয়া নেই অথবা তারা বউয়ের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করে না। আর যদি মহিলা হয়, তাহলে মনে করতে হবে, এরা লোভ, জেদ ও অহঙ্কারের কারণে স্বামী হারিয়ে একাকীত্ব জীবনযাপন করছে অথবা তারা নারীত্ব হারিয়ে মানসিকভাবে পুরুষে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া এর কারণ এটাও হতে পারে, এসব নারীর স্বামীগুলো লম্পট অথবা মানসিক রোগে আক্রান্ত। ফলে তারা কখনো সত্যিকারের সুপুরুষের সান্নিধ্য পেতে সক্ষম হয়নি। সারকথা হচ্ছে, এসব পুরুষ ও নারীকে শয়তান পার্থিব ভোগ-সম্মানের মোহে এমনভাবে বন্দি করে রেখেছে, তারা তাদের মহাপরাক্রমশালী স্রষ্টা ও প্রভু দয়াময় আল্লাহকে এবং তাদের ওপর তাঁর প্রভুত্বের অধিকারকে ভুলে গেছে। কেয়ামতের দিন তাদের বিচার আল্লাহ কীভাবে করবেন, তার কিঞ্চিত ইঙ্গিত তিনি পবিত্র কোরআনে দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, (সেদিন ফেরেশতাদের নির্দেশ দেওয়া হবে) একে ধরো এবং আগুনের মাঝখানে নিক্ষেপ করো। অতঃপর তার মাথার ওপর দাহকারী গরম পানি ঢালো। তুমি না খুবই প্রভাবশালী সম্মানীয় মানুষ! আজ অহঙ্কারের স্বাদ অনুভব করো। এ হচ্ছে সে বিষয়, যার ব্যাপারে তোমরা (নাস্তিক, মুরতাদ, বেদীন লম্পট) সন্দেহ পোষণ করতে।’ (সুরা আদ দুখান, আয়াত : ৪৭-৫০)

মহান রাব্বুল আলামীন অন্য সুরায় বলেছেন, ‘একে ধরে বেড়ি পরাও এবং আগুনে নিক্ষেপ করো। অতঃপর ৭০ হাত দীর্ঘ শিকলে তাকে আবদ্ধ করো। সে মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখতো না এবং অসহায়কে অন্নদানে কাউকে উৎসাহ দিতো না। তাই আজ এখানে তার কোনো বন্ধু নেই এবং গলিত পুঁজ ছাড়া আর কোনো খাবার নেই।’ (সুরা আল হাক্কাহ, আয়াত : ৩০-৩৬)

একজন পিতা-মাতা, চাচা-মামা বা বড় ভাই যদি সীমালঙ্ঘন থেকে বিরত রাখার জন্য তাদের পোষ্য নারীদের মারার অধিকার কোনো সমাজে ভোগ করতে পারে, তাহলে সে সমাজে একজন দায়িত্বশীল স্বামীর অবুঝ ও উগ্র স্বভাবের কোনো স্ত্রীর সীমালঙ্ঘন রোধ করার জন্য তার প্রতি হাল্কা-পাতলা মারার অধিকার কি অস্বাভাবিক বিবেচিত হতে পারে? বুদ্ধি নিয়ে বিপাকে থাকা কোনো নরাধম এটাকে অন্যায় ভাবলেও মহান রাব্বুল আলামীনের দৃষ্টিতে এটা অন্যায় নয়। স্ববিরোধী এই নরাধমদের দুনিয়াতে কিছুদিনের জন্য বাঁচার অধিকার দেবার অর্থ এই নয় যে, মহান আল্লাহ তাদের এ ধৃষ্টতার শাস্তি দিতে অক্ষম। তাদের এ অবকাশ দেবার কারণ হলো, তাদের অপরাধের ষোলকলা পূর্ণ করা। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আমার অবাধ্যরা যেন কখনো এ কথা মনে না করে যে, আমি তাদেরকে যে অবকাশ দিচ্ছি, তা তাদের কল্যাণে যাবে। আমি তাদেরকে অবকাশ দিচ্ছি এ জন্য, যাতে তারা তাদের অপরাধের ষোলকলা পূর্ণ করতে পারে। তাদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি প্রস্তুত করাই আছে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১৭৮)

একদিনের ঘটনা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তোমরা আল্লাহর বাঁদিদেরকে (অর্থাৎ স্ত্রীদের) মেরো না।’ পরে হজরত উমর ফারুক (রা.) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, ‘স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের ওপর চড়াও হয়ে গেছে।’ ফলে তিনি তাদেরকে মারার অনুমতি দিলেন। এতে অনেক মহিলা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবারের কাছে এসে তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল। এ অবস্থা দেখে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তোমাদের অনেক মহিলা এসে মোহাম্মদের পরিবারের কাছে তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। ওরা (ওই স্বামীরা) তোমাদের মাঝে উত্তম লোক নয়।’ (আবু দাউদ, হাদিস নং-২১৪৬) যেসব পুরুষ খারাপ প্রকৃতির তারা ইসলামের অনুমতি না দিলেও স্ত্রীদের মারতো। যেখানে ওরা আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘন করে খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, চুরি ও চাঁদাবাজি করছে, সেখানে কী তারা স্ত্রীদের প্রতি খুবই দয়াপ্রবণ হতো। কখনোই না। ইসলাম স্ত্রীদের হাল্কা-পাতলা মারার অনুমতি দিয়েছে-তাদের সংশোধনের জন্য, নির্দয়ভাবে তাদেরকে পিটিয়ে প্রতিশোধ নেবার জন্য নয়। যারা এরকম করবে, তাদের পরিচয় তারা অপরাধী। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে কোনো অপরাধী অবাধে তার অপরাধ চালিয়ে যেতে পারে না, এটাই বাস্তব সত্য।

 

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিআতুস সুফফাহ আল ইসলামিয়া গাজীপুর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads