শেখ এ কে এম জাকারিয়া
যুগে যুগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ-জাতি-সম্প্রদায় বা গোত্রের নারীরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এ বৈষম্য সেই আদিকাল থেকে আজো আমাদের সমাজে বিদ্যমান। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় পরাধীন দেশের সমাজ থেকে এ বৈষম্য দূর করতে সে সময় সবার আগে যিনি এগিয়ে এসেছিলেন, তিনি বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন বাংলাদেশে নারীর শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম নারী সংগঠন মহিলা সমিতির ভিত নির্মাণ করেন। তিনিই রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র বা পরিচালনা সংক্রান্ত মূলনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নের নানা কর্মক্ষেত্র সংযুক্ত করেন।
বঙ্গবন্ধু শিশু ও কিশোরীদের আত্মসম্মানবোধ প্রতিষ্ঠা, স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা-অনুরাগ ও সুনীতিসংক্রান্ত বিদ্যাচর্চায় সুশিক্ষিত করতে ‘পূর্ব পাকিস্তান গার্লস গাইড’ অ্যাসোসিয়েশনকে ঢেলে সাজান। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে ‘বাংলাদেশ গার্লস গাইড’ অ্যাসোসিয়েশনকে আবার নতুন করে গড়ে তোলার জন্য সংসদ উপনেতা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে দায়িত্ব দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে নারীর রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংহত করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদে নারীর জন্য জাতীয় সংসদের আসন সংরক্ষিত রাখা হয়। প্রথম সংসদের সংরক্ষিত আসনে মাত্র ১৫ জন নারী সভাসদ নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীকালে তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ জনে উন্নীত হয়। এক্ষেত্রে ৬৫(২) অনুচ্ছেদের অধীনে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত ৩০০ আসনেও নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। প্রসঙ্গত ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিসভায় দুজন নারী মন্ত্রী ছিলেন।
এছাড়াও তিনি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা শাসিত রাষ্ট্রের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমঅধিকারেরও স্বীকৃতি দিয়েছেন। রাষ্ট্রের এ গঠনতন্ত্রের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে, রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতি হিসেবে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা লেখা হয়েছে। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে আছে মৌলিক অধিকার হিসেবে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সমান অধিকার। ২৭ নং অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে, সব নাগরিক আইনের চোখে সমান এবং আইনের সম-আশ্রয় লাভের অধিকার পাবে। এছাড়াও সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে।
১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম মুসলিম বিবাহ এবং বিবাহ রেজিস্ট্রিকরণ আইন প্রণীত হয়। এছাড়া তিনি নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত করেন। ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘বীর নারী’। তিনি এভাবে নারীদের সমাজস্বীকৃত সম্মান প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’। এ বোর্ড গঠনের মূল লক্ষ্য ছিল নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন ও আবাসনের ব্যবস্থা করা। যুদ্ধ পরবর্তীকালীন এ জটিল বিষয় তিনি দৃঢ়চিত্তে মোকাবিলা করেছেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিক (১৯৭৩-৭৮) কর্মপ্রণালিতে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতি হয়েছে এমন নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, সামগ্রিকভাবে সমাজের কল্যাণমূলক চিন্তা, আদর্শ, তত্ত্ব ও প্রয়োগসংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচি গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারীর উন্নয়নকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি এ খাতে বিপুল অর্থ বরাদ্দ দেন।
তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন এমন পরিবারের সদস্যদের জন্য বিশেষ করে শহীদের স্ত্রী-কন্যাদের জন্য চাকরি ও ভাতার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া নারী পুনর্বাসন বোর্ডের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে উৎপীড়িত, ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও শিশুর ঠিক তথ্য সংগ্রহের জন্য জরিপ কাজ সম্পাদন করা, তাদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, যুদ্ধের সময় অত্যাচারিত নারীদের নানাপ্রকার বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ অর্থাৎ চাকরির উপযোগী বা চাকরির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ শিক্ষা প্রদান করা, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক লাঞ্ছিত বীরাঙ্গনা নারীসহ যেসব পরিবারের রোজগেরে পুরুষ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন, সেসব পরিবারের নারীদের চাকরি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
যতদিন অতিবাহিত হয় নারী পুনর্বাসন বোর্ডের দায়িত্ব ও কাজের সীমারেখা তত বাড়তে থাকে। যে কারণে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে বোর্ডকে আবার নতুন করে গড়ে তুলে সংসদে ‘নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন’-এ রূপান্তরিত করার আইন পাস করেন। এ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সময়ে নারীদের উন্নয়নে জেলা ও মহকুমায় ভৌত অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়। নারীদের জন্য বিস্তৃত কাজের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে চাকরির উপযোগী বা চাকরির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। নারীকে উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করে প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। যুদ্ধে ক্ষতি হয়েছে এমন পরিবারের কিশোর-কিশোরীদের পড়ালেখার জন্য বৃত্তিপ্রথাও চালু করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সেই নীতি ও আদর্শকে অপ্রতিহত রেখে তারই যোগ্য কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীর অংশগ্রহণকে আরো টেকসই ও সুগঠিত করেছেন।
লেখক : মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, সদর হাসপাতাল, সুনামগঞ্জ