মুক্তমত

নাগরনো কারাবাখ যুদ্ধ, শান্তিচুক্তি এবং কিছু কথা

  • প্রকাশিত ২৭ নভেম্বর, ২০২০

মো. জাফর আলী

 

 

নাগরনো কারাবাখ ইউরোপের ককেশাস অঞ্চলে অবস্থিত দুর্গম পাহাড়, বনভূমি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকার নাম। এখানে জাতিগত আর্মেনীয়রা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং প্রাচীন খ্রিস্টীয় সভ্যতার উপস্থিতির জন্য খ্রিস্টানদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে মুসলিম মনীষীদের জন্মস্থান ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো থাকার কারণে আজেরি মুসলিমদের কাছেও অনেক তাৎপর্যপূর্ণ স্থান এটি। ৪ হাজার ৪০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই এলাকাটি অবস্থানগত দিক থেকে জাতিসংঘের স্বীকৃতি অনুযায়ী আজারবাইজানের হলেও আর্মেনিয়ার সঙ্গে ১৯৮০-র দশকের শেষের দিক থেকেই একধরনের ঝামেলা বিদ্যমান। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯৯১ সালে নাগরনো কারাবাখ নিয়ে দুটি সাবেক সোভিয়েত প্রজাতান্ত্রিক দেশ, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব জোরালো হয়।

বিশেষ করে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভাজনের সময় এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগত আর্মেনীয়রা, যখন আর্মেনিয়ার সঙ্গে থাকার পক্ষে ভোট প্রদান করে, তখনই মূলত একটি বড় ধরনের সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে। এক পর্যায়ে এ সংঘাত চরম আকার ধারণ করে এবং আজারবাইজানের নাগরনো কারাবাখসহ এর আশপাশের আরো সাতটি এলাকা আর্মেনীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় আজারবাইজানকে পরাজিত করার মাধ্যমে দখল করে নেয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। এ সংঘাতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে এবং প্রায় ছয় লাখ (কোনো কোনো তথ্যমতে ১০ লাখ) আজেরি নাগরিক নিজ নিজ বাসস্থান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ফ্রান্স— এই তিন দেশ মিলে ১৯৯৪ সালে যুদ্ধবিরতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান এতে আসেনি।

উল্লেখ্য, আজারবাইজান ককেশাস পর্বতমালা ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত এবং পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়াকে সংযুক্ত করেছে। যার কারণে ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ দেশটি। আর ইতোমধ্যে এই দেশ কাস্পিয়ান সাগর এলাকা থেকে প্রচুর পরিমাণ তেল ও গ্যাসসহ অন্যান্য অনেক খনিজসম্পদ আহরণ করে অর্থনীতিতে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করেছে (এজন্যই কাস্পিয়ান তীরের দুবাই বলা হয় আজারবাইজানকে)। বিশেষ করে, সামরিক খাতে তাদের এত বিনিয়োগ অবাক করার মতো। অর্থাৎ সমরাস্ত্র বৃদ্ধির দিক থেকে প্রতিরক্ষা খাতে দেশ হিসেবে একধরনের সফলতাই অর্জন করেছে বলে মনে করা হয়। পাশাপাশি তুরস্ক ও ইসরাইলসহ বিভিন্ন শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে রয়েছে এর শক্ত কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক।

যখন আজারবাইজান বিভিন্ন দিক থেকে একধরনের স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগোচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ গত সেপ্টেম্বর মাসে আর্মেনিয়ার পক্ষ থেকে দেশটির সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এতে সুযোগ পেয়ে দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর চুপ থাকার পর গত ২৭ সেপ্টেম্বর কারাবাখে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে নিজ দেশের জনগণের সমর্থন নিয়ে বিরাট এক সামরিক অভিযান শুরু করে আজারবাইজান। ওই অভিযানের প্রথম থেকেই আর্মেনিয়া অনেকটা ধরাশায়ী হতে থাকে আজারবাইজানের কাছে এবং পিছু হটতে থাকে। শুরুতেই আজারবাইজান আর্মেনিয়ার একটি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। ট্যাংক, সামরিক যান, আর্টিলারি, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, অস্ত্রের গুদাম, ট্যাংক ধ্বংসকারী গান ও গাড়িসহ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূল্যের আর্মেনিয়ার অসংখ্য সামরিক অস্ত্র ধ্বংস করে এবং অনেক অস্ত্র নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতেও সক্ষম হয় আজারবাইজান। উপরন্তু এক ডজনেরও বেশি গ্রাম ও শহর আর্মেনিয়ার কাছ থেকে মুক্ত করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর্মেনিয়ার পিছু হটা ও আজেরিদের দখলমুক্ত করাই ছিল এই কয়েকদিনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই যুদ্ধে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দুবার যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এলেও সেগুলো ব্যর্থ হয়।

এই সংঘাতে আর্মেনিয়া সার্বিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি তাদের ২ হাজার ৩১৭ জন সেনার লাশ শনাক্ত করার কথা জানিয়েছে। তাছাড়াও দুই দেশের অন্তত ৫ হাজার লোকের প্রাণহানি এবং কমপক্ষে ৮ হাজার লোক আহত হয়েছে। কারাবাখের ৪ হাজার বাসিন্দা বিভিন্নভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে, আবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে অগণিত মানুষ। অধিকাংশ ভূমি নিজেদের আয়ত্তে আনার পর, অবশেষে কারাবাখের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ‘সুশা’ দখলমুক্ত করলে অবশিষ্ট অংশসমূহ ফিরে পেতে আজারবাইজান সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে যায়। কারণ এ শহরের উঁচু স্থানগুলো থেকে আর্মেনীয় যোদ্ধাদের সহজে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ঠিক করা সম্ভব হতো।

এমতাবস্থায় ৯ নভেম্বর রাতে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান এক শান্তি চুক্তিতে একমত হয়। এই চুক্তির শর্ত হলো— আর্মেনিয়া বাকি এলাকাগুলো থেকে ডিসেম্বরের আগেই তাদের সেনা প্রত্যাহার করবে এবং নাগরনো-কারাবাখ জুড়ে আজারবাইজানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। আর দুই দেশের মধ্যকার ৫ কিলোমিটার করিডোরের নিয়ন্ত্রণে শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে পাঁচ বছর টহল দেবে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। ইতোমধ্যে ১৯৬০ জন সেনা, কিছু সামরিক বিমান ও পর্যাপ্ত পরিমাণে সমরাস্ত্র নিয়ে রাশিয়ার শান্তিরক্ষীরা কারাবাখে অবস্থান করছে। কিন্তু আজারবাইজান তুরস্কের সেনাবাহিনীকেও শান্তিরক্ষী বা পর্যবেক্ষক হিসেবে চাচ্ছে এবং তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার এ ব্যাপারে কথাও হয়েছে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে।

অধিকাংশ বিশ্লেষক উক্ত শান্তি চুক্তিকে আর্মেনিয়ার পরাজয় হিসেবেই দেখছেন। এদিকে চুক্তির পর গোটা আজারবাইজানে আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে এবং প্রেসিডেন্ট ইলহাম অলিয়েভ একে তার দেশের জন্য ঐতিহাসিক বিজয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অপরদিকে আর্মেনিয়ার জনগণ এই চুক্তি কোনোভাবেই মানতে পারছে না। চুক্তি ও সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মাধ্যমে তারা সর্বত্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুরের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি পার্লামেন্টের স্পিকারকে মারধরের কথাও অজানা নয়। আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী এই চুক্তিকে নিজ দেশের জন্য অবর্ণনীয় ও বেদনাদায়ক বলে উল্লেখ করেছেন এবং বারবার বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করে তার জনগণকে বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই চুক্তিকে পরাজয় হিসেবে নেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, চলমান সংকট সমাধানের জন্য সামগ্রিক দিক বিবেচনায় এটিই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা ছিল। বলা যায়, গত তিন দশকে আজারবাইজান যা শুধু স্বপ্নেই দেখেছিল, এই দেড় মাস সময়েই তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। চুক্তি থেকে বোঝা যায়, আজারবাইজান যুদ্ধ করে কারাবাখের অধিকাংশ এলাকা জয় করার পাশাপাশি বিনাযুদ্ধে আরো দুই-তিনটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads