সুনামগঞ্জের ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণের জন্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান নাইকোকে দায়ী করা হয়েছে। এ ঘটনায় বাংলাদেশের জ্বালানি সম্পদের পাশাপাশি আর্থিক, স্থানীয় পরিবেশ ও স্বাস্থ্যেরও বিপুল ক্ষতি হচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে নাইকোকে।
আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তির প্লাটফর্ম ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপুটেড (ইকসিড) এ রায় ঘোষণা করেছে।
এই রায়ের ফলে নাইকোর কাছে বাংলাদেশ ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ পাবে। যদিও ইকসিড স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি নির্ণয় করে বাংলাদেশকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে বলেছে। সব মিলিয়ে আগামী বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
রোববার দুপুরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ অনলাইনে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এসব তথ্য জানান।
তিনি জানান, দীর্ঘ ১০ বছর আইনি মামলা লড়ার পর এই রায় বাংলাদেশের পক্ষে এসেছে। এতে প্রমাণ হয়েছে গ্যাসের খনি খননে নাইকোর গাফলতি ছিল। তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। রায় পক্ষে আসাতে সারা বিশ্বের কাছে বার্তা গেছে বাংলাদেশে গিয়ে যা ইচ্ছা তাই করা যাবে না। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ইকসিড এই রায় প্রদান করে। তবে মার্চের শুরুর দিকে এ তথ্য জানানোর পরিকল্পনা থাকলেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়ায় তা বাতিল করা হয়।
পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স সূত্র জানায়, ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণের কারণে বাংলাদেশের অন্তত এক হাজার ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে। এর পাশাপাশি পরিবেশ, প্রতিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হয়েছে, হচ্ছে। সেই ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে পেট্রোবাংলার নিয়োগ করা একটি বহুজাতিক কোম্পানি কাজ করছে।
এদিকে আগের গ্যাস বিক্রির বিল বাবদ নাইকো পেট্রোবাংলার কাছ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার পাওনা রয়েছে। ইকসিডে এ বিষয়ে পৃথক মামলা করেছে নাইকো। বাংলাদেশ সেই দেনা অস্বীকার করেনি। তবে বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ সাপেক্ষে তা পরিশোধ করবে বলে জানিয়েছে। বাংলাদেশে নাইকোর একমাত্র সম্পদ ব্লক-৯ এর গ্যাসের অংশীদারিত্ব। যার মূল্য ২৮০ ডলারের মত। সেই হিসেবে গ্যাসের অপচয় বাবদ যে ক্ষতি হয়েছে তা থেকে গ্যাসের বকেয়া বিল ও ব্লক-৯ এর মূল্য বাদ দিলেও ৭০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি পাবে বাংলাদেশ। তার সঙ্গে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতিপূরণ যুক্ত হবে। ইকসিডের ফেব্রুয়ারির রায়ে ক্ষতি ও নাইকোর দায় উল্লেখ করা হলেও কত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। পরবর্তী রায়ে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ জানানো হবে। তবে নাইকো ইতোমধ্যে দেউলিয়ায় হয়ে গেছে। সে হিসেবে তারা কীভাবে ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধ করবে তা আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
প্রতিমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে আরও জানান, ২০১৬ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দিয়ে যে ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করা হয় তা ২০১৮ সালে ইকসিডে জমা দেয়া হয়েছে। ইকসিড রায়ে বলেছে নাইকোর গাফিলতি এবং অদক্ষতার জন্যই বিস্ফোরণ ঘটেছে। ফলে এর দায় নাইকোকেই নিতে হবে। বাংলাদেশকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ক্ষতির বিষয়টি চূড়ান্ত করতে আগামী সেপ্টেম্বরে আবার শুনানি হওয়ার কথা ছিল। করোনা পরিস্থিতির কারণে সেটি পেছাবে।
এই মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার মঈন গণি জানান, বাপেক্স এর ১১৮ মিলিয়ন ডলার এবং পেট্রোবাংলার ৮৯৬ মিলিয়ন ডলার মিলিয়ে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা করা হচ্ছে। এর বাইরে আদালত বলেছে স্বাস্থ্যগত ক্ষতি এবং পরিবেশ এবং প্রতিবেশের ক্ষতি নিরুপণ করে আদালতে জমা দিতে। এতে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
তিনি আরও জানান, আগামী সেপ্টেম্বরে আরও একটি শুনানি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন করোনার কারণে সেটি সম্ভব হবে না। ফলে আমাদের পরিস্থিতি ভাল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আগামী বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ ঠিক হওয়ার জন্য সময় প্রয়োজন হতে পারে। এজন্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
জ্বালানি সচিব বলেন, আমাদেরকে এই অর্থ তাদের দিয়ে দিতে হত। এখন আর দিতে হচ্ছে না। আবার এর ফলে সারা বিশ্বের কাছেই একটি সুন্দর বার্তা পৌঁছেছে। এটিও বিবেচনা করতে হবে।
প্রসঙ্গত, গ্যাসকূপ খনন করার সময় ২০০৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ছাতকে প্রথম দফা বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর আবার চেষ্টা করতে গেলে আরও এক দফা বিস্ফোরণ ঘটে। এতে খনিটিতে থাকা গ্যাসের অনেকটা পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র বিলুপ্ত হয়। এখনও ছাতকে এই গ্যাস ক্ষেত্রের আশেপাশের এলাকায় গ্যাস উদগীরণ ঘটছে।