ধর্ম

নবীজিকে ভালোবাসার ঈমানদীপ্ত উপমা

  • প্রকাশিত ৪ নভেম্বর, ২০২০

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের কলিজার টুকরা। সব উম্মতের হূদয়ের স্পন্দন। তাঁর প্রতি ভালোবাসা  নেই এমন মুসলমান পাওয়া যাবে না। যদি কেউ থাকে তার ঈমান পূর্ণ নয়। নবীজির প্রতি ভক্তি, ভালোবাসা, ঈমানের শর্ত। ঈমানদারের ঈমান ও অন্তরের দৃঢ় প্রত্যয়ের পরিমাপক। আমাদের ঈমান তখনই পূর্ণাঙ্গ হবে যখন নবীজির প্রতি ভালোবাসা দুনিয়ার সবকিছু, এমনকী আমাদের নিজ জীবন অপেক্ষা অধিক হবে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নবী ঈমানদারদের নিকট তাদের জান-প্রাণ থেকেও অধিক ঘনিষ্ঠ।’ (সূরা আহযাব : ৬)। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সব মানুষ অপেক্ষা প্রিয় হবো। (বুখারী, মুসলিম)

সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কতোটা মুহাব্বত করেছেন, ভালোবেসেন, প্রাধান্য দিয়েছেন তা কল্পনাতীত। নবীজির প্রতি তাঁদের ভালোবাসার কিছু ঈমানদীপ্ত দৃষ্টান্ত আমি পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি।

এক. ওহুদ যুদ্ধের সময় যখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শির মোবারকে শিরস্ত্রাণের দুটি কড়া ঢুকে পড়লো। হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত উবায়দা (রা.) অধীরচিত্তে দৌড়ে এলেন। দাঁত দিয়ে শিরস্ত্রাণের কড়া টেনে বের করে আনলেন। হযরত উবায়দা (রা.) এর একটি দাঁত ভেঙ্গে গেল। কিন্তু তিনি দমলেন না অপর কড়াটিও দাঁত দিয়ে টেনে বের করে আনলেন। এতে তার আরেকটি দাঁত ভেঙ্গে গেল। কড়াটি বেরিয়ে এলে নবীজির মাথা মোবারক থেকে রক্তের ফিনকি ছুটছিল। এ দৃশ্য দেখে সাহাবী মালেক ইবনে সিনান দৌড়ে এলেন এবং তাঁর দুই অধরে নবীজির রক্তচুষে পান করে ফেললেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন, ‘যার রক্তের সাথে আমার রক্ত মিশে গেছে তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না।’

দুই. ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানরা যখন সাময়িক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। উদ্ভ্রান্ত, তটস্থ এক নারী ছুটে চলেছেন। একজন সংবাদ দিলেন ‘তোমার বাবা শহীদ হয়েছেন’ ভ্রক্ষেপ না করে আনমনে ইন্নালিল্লাহ বলে কী যেন খুঁজতে খুঁজতে  সামনে ছুটে চলছেন। এরপর এক এক করে তাঁর স্বামী, ভ্রাতা ও পুত্রের শাহাদাতের সংবাদ জানানো হলো তাঁকে। কিন্তু তিনি ইন্নালিল্লাহি উচ্চারণ করে বারবার মানুষের কাছে শুধু প্রিয়নবীর কথাই জিজ্ঞেস করছিলেন, আগে বলো আমার নবী কেমন আছেন? এক সময় তিনি শুনতে পেলেন যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভালো আছেন। কিন্তু ব্যাকুল হূদয় তাতেও শান্ত হলো না। এরপর নবীজিকে স্বচক্ষে দেখেই তবে শান্ত হলেন সেই আনসারী নারী সাহাবী। রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা।

তিন. খুবাইব (রা.) বন্দি হওয়ার পর কাফিররা তাঁর দেহের অঙ্গগুলো যখন একের পর এক বিচ্ছিন্ন করতে থাকে তখন তারা বলে, তুমি কি চাও তোমাকে ছেড়ে দিয়ে তোমার পরিবর্তে তোমার নবী মুহাম্মদকে হত্যা করি? খুবাইব (রা.) এই করুণ অবস্থায়ও বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমি মুক্তি পেয়ে আমার পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে যাব আর আমার নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর গায়ে কাটার আঁচড় লাগবে, তা হতে পারে না।’

চার. সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ ইবনে আবদি রাব্বিহি (রা.)। তিনি তাঁর বাগানে ফল-ফলাদি ও গাছ-গাছালি দেখাশোনা করছেন। এমন সময় নবীজির ইন্তিকালের সংবাদ শুনতে পেলেন। হূদয়ের কোমল বৃত্তে তিনি আচমকা প্রচণ্ড আঘাত পেলেন। দুঃখে-শোকে আর মহব্বতের অতিশায্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বসলেন, হে আল্লাহ! আমার দৃষ্টিশক্তি রহিত করে দাও। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে আমি এই চোখ দিয়ে আর কিছুই দেখতে চাই না। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত এই প্রার্থনা বৃথা গেল না। সত্যিই দৃষ্টিশক্তি রহিত করে দেওয়া হলো তার।

পাঁচ. হযরত যায়েদ ইবনে দাসানা (রা.) কাফিরদের হাতে বন্দি হবার পর পাপিষ্ঠরা তাকে শূলে চড়ানোর আয়োজন করে। তামাশা দেখার জন্য সমবেত হয় অনেক লোক। আবু সুফিয়ান (রা.) তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি নরম সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, যায়েদ! সত্যি করে বলোতো; আল্লাহর শপথ দিয়ে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি? তুমি কি এটা পছন্দ কর যে, তোমার পরিবর্তে মুহাম্মদের গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হোক আর তোমাকে হাসিমুখে তোমার পরিবারের নিকট ফিরিয়ে দেওয়া হোক। হযরত যায়েদ (রা.) দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিলেন, আল্লাহর শপথ! নবীজির যাত্রাপথে একটি কাঁটা লুকিয়ে রাখা হবে আর আমি ঘরে বসে আরাম করবো এতটুকুও আমার সহ্য হবে না। হযরত যায়েদের জবাব শুনে সেদিন মক্কার কাফেররা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। আরব নেতা আবু সুফিয়ান মন্তব্য করেছিলেন,  মোহাম্মদের প্রতি তার সাথীদের যে ভালোবাসা আমি দেখেছি, অন্য কারো প্রতি এমন ভালোবাসা আমি আর কখনো দেখিনি।

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা ইমানের দাবি। আর নবীজির শানে কটূক্তি করা, মন্দ বলা, গালি-গালাজ করার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি রয়েছে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন-‘আর তাদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা নবীকে কষ্ট দেয় এবং বলে, সে তো কান (নির্ভর)। তুমি বলে দাও, সে তোমাদের যা কল্যাণকর তার কান...। আর যারা আল্লাহর রাসুলকে কষ্ট দেয়, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (সূরা তাওবা  : ৬১-৬৩)। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি দুনিয়া ও আখেরাতে লানত করেন এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন লাঞ্ছনাকর শাস্তি। (সূরা  আহযাব : ৫৭)। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের শানে কোনো মুমিন কটূক্তি করতে পারে না, কষ্ট দিতে পারে না। আর যারা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের বিরোধিতা করবে তাদের সাথেও কোনো মুহাব্বত রাখা যাবে না। আল্লাহআক বলেন-‘তুমি পাবে না আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী এমন কোনো সমপ্রদায়, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরোধিতাকারীদের ভালোবাসে। (সূরা মুজাদালা : ২২)। এখানে বলা হয়েছে-যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরোধিতা করে তাদের সাথে যারা সম্পর্ক রাখে তারা মুমিন নয়। সুতরাং যারা স্বয়ং বিরোধিতা করে তাদের হুকুম কী হবে সহজেই আন্দাজ করা যায়।

আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিস, ‘এক অভিশপ্ত ইহুদি মহিলা নবীজিকে গালমন্দ করত। ফলে একলোক অভিশপ্ত মহিলাটাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ফেলে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহিলার রক্ত মূল্যহীন ঘোষণা করেন।’ (আবু দাউদ- ৪৩৬৪)। ইমাম খাত্তাবি রাহিমাহুল্লাহ বলেন-এ হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, আল্লাহর নবীর গালমন্দকারীকে হত্যা করা হবে। কারণ, গালমন্দ বা অমার্জিত ভাষা ব্যবহার করা ‘ইরতিদাদ আদদ্বীন’ বা ইসলাম থেকে পরিত্যাগ। (খাত্তাবি, মায়ালিমুস সুনান : ৩/২৯৬)।

ইহুদি কবি ও গোত্রনেতা কাব ইবনে আশরাফের ঘটনা। এটি একটি প্রসিদ্ধ ও স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। একদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘কে আছো কাব ইবনে আশরাফের জন্য (যে তার গর্দান উড়িয়ে দেবে)? কেননা সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে কষ্ট দিয়েছে।’ তখন মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে অনুমতি নিয়ে কাবকে হত্যা করেন। (বুখারী : ৩৮১১, মুসলিম : ৪৭৬৫)। ইহুদি কাব ইবনে আশরাফ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিন্দা করত আর নোংরা অপবাদ দিত। ফলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে হত্যা করার আহ্বান জানান। তার দলবল নবীজির কাছে এসে বলল, ‘আমাদের নেতা কাবকে গুপ্তহত্যা করা হয়েছে।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘অন্যদের মতো সেও যদি সংযত থাকত তাহলে এমন ক্ষতির মুখোমুখি হতো না। সে আমাদেরকে কষ্ট দিয়েছে, আমাদের ব্যাপারে কটূ মন্তব্য করেছে। তোমাদের কেউ যদি এমন জঘন্য কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তাহলে তরবারিই তার ফায়সালা করবে।’ তখন ইহুদিরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কাব ইবনে আশরাফের হত্যার পর থেক তারা পুরোপুরি সাবধানী হয়ে ওঠে। এমন ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে শুরু করে।

আবদুল্লাহ মাসউদ

লেখক : আলেম-প্রাবন্ধিক, যাত্রাবাড়ী মাদরাসা, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads