কবির চিন্তা দূরগামী। কবি হুমায়ুন আজাদের সেরকম দূরগামী একটি পিক্ত ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’। তিনি যে উদ্দেশ্যে, যেভাবেই লিখে থাকুন না কেন, কথাটি যে নানাদিক থেকে এত দ্রুত ধেয়ে আসতে থাকবে, এত দ্রুত সত্যি হয়ে উঠতে শুরু করবে— এটা আমাদের দূরতম ভাবনাতেও হয়তো ছিল না। আশঙ্কা ছিল, সেই আশঙ্কার কারণও ছিল। কিন্তু সেই আশঙ্কাই যে সত্যি হয়ে উঠতে শুরু করবে, আমাদেরকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফিরতে থাকবে— এতটা দূরগামী ভাবনা আমরা ভাবিনি। কবির দূরগামী ভাবনা থেকে উঠে আসা কথামালাই এখন আমাদের সমাজে বড় সত্যি হয়ে উঠতে শুরু করেছে। প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে এমন সব খবর জন্ম নিচ্ছে যা রীতিমতো আতঙ্কের, রীতিমতো ভয়ের। সেসব খবর আমাদের সামনের অন্ধকার দিকগুলোই যেন নির্দেশ করছে।
খুব হতাশার মনে হলেও একে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। অবক্ষয়ের চিহ্নগুলো আজ বড় স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে, ফলে ঝেড়ে ফেলারও সুযোগ নেই। কারণ একটির সঙ্গে অন্যটির সুতা বাঁধা। গুজবে হত্যাকাণ্ড, প্রতিনিয়ত নারী ধর্ষণ, মতানৈক্যের বিপরীতে হত্যা, শুভবোধ, ন্যায়বোধ, নৈতিকতা ক্রমশ ভঙ্গুর হচ্ছে, আর তাই খুব জটিল এবং বড় কোনো কারণ ছাড়াই ঘটছে যত্রতত্র এসব হত্যাকাণ্ড। পাড়ায় মহল্লায় গজিয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। বেপরোয়া এসব কিশোরের হাতে জিম্মি মহল্লার বয়স্ক থেকে নারী, এমনকি শিশুরাও। কত তুচ্ছ ঘটনায় ঘটছে এসব হত্যাকাণ্ড। পদ্মা সেতু নির্মাণে মাথা লাগবে, ছেলেধরা গুজব, নেতৃত্ব— ইত্যাদি বিষয়ে প্রথমে কথা কাটাকাটি। সেই কথা কাটাকাটি শেষ হয় মারামারিতে, অবশেষে খুন— পরিণতি মৃত্যু। অথচ সবকিছু ঘটছে আমাদের চোখের সামনে, আমরা নিরুপায়। কিন্তু সমাজনেতাদের ভাবতে হবে, আমাদের সন্তানরা কেন এমন বিপথগামী? তাদের এখনি রুখতে না পারলে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিষ্ফলা হয়ে যাবে। দুবছর আগে ঘটিত এমন একটি কিশোর অপরাধ আমার চেতনায় আজও করাঘাত করে।
রাজধানীর উত্তরায় খেলার মাঠে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। সেই কিশোরকে হত্যার সঙ্গেও জড়িয়ে ছিল প্রায় তারই বয়সী কিশোররা। সেদিনের সেই কিশোরকে হত্যার কারণও ছিল খুব সামান্য। কিশোররা মোবাইলে ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস নামের একটি গেমস থেকে নিজেদের মধ্যে তৈরি করেছিল বিভিন্ন দল। সেইসব দল গেমসে ফাইটিং করে। গেমসের দলের আদলে কিশোররা উত্তরায় গড়ে তোলে বিগবস, ডিসকো বয়েজ উত্তরা, পাওয়ার বয়েজ উত্তরা, নাইন এমএম বয়েজ উত্তরা ও নাইন স্টার-এর মতো নামের দল। এরপর তারা গেমসের ফাইটিং বাস্তবেও প্রয়োগ শুরু করে। দলগুলো একটির সঙ্গে অন্যটির মারামারি, ক্ষমতার দাপট ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। তারই পরিণতিতে খুন হয় অষ্টম শ্রেণির কিশোর। এগুলোও আমাদের অজানাই থেকে যেত যদি না সেই কিশোর খুন হতো। এ রকম ভয়ংকর গেমসের খবর স্মৃতি থেকে মিলিয়ে যেতে না যেতেই সামনে এলো ব্লু হোয়েল নামের আরেক প্রাণঘাতী গেমসের কথা। কয়েকদিন পত্র-পত্রিকা আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমজুড়ে থাকল ব্লু হোয়েল। এক কিশোরীর মৃত্যুর খবরও প্রচারিত হলো। নতুন সূর্য যখন নতুন জীবনের গল্প বুনছে, তখন এসব কথা বলতে ভালো লাগে না। তবু বলতে হয়, আমাদের আগামীর পথকে মসৃণ করার স্বার্থেই।
এ রকম ঘটনা যেমন আজ আর বিচ্ছিন্ন নয়, তেমনি তা থেমেও নেই। নানান রূপে তার প্রকাশ ঘটছে, দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। ফলে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এমন করুণ আর অকাল মৃত্যুর খবর আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে। যার কোনো কোনোটি সংঘটিত হচ্ছে দলবদ্ধভাবে, কোনো কোনোটি একক, আবার কখনো কখনো আমাদের কিশোররা নিজেরাই নিজেকে হত্যা করছে। আমাদের স্বার্থপরতায়, আমাদের নীতিহীনতায় ঘরগুলো যেমন শিশুদের জন্য শান্তির আশ্রয় হয়ে উঠছে না, তেমনি ঘরের বাইরের পৃথিবীও তাদের জন্য বসবাস উপযুক্ত হয়ে উঠছে না। ফলে কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে নানা জটিলতায়। যা থেকে অনেক সময় অকালে ঝরে পড়ছে সম্ভাবনাময় প্রাণ। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের শিশুবান্ধব শহরের সংজ্ঞা বলছে, শিশুবান্ধব শহর হতে হলে সড়কে শিশুদের নিরাপদে চলাচলের সুযোগ থাকতে হবে। দূষণমুক্ত পরিবেশের পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে পর্যাপ্ত সবুজ চত্বর, যেখানে শিশুরা বাধাহীনভাবে খেলতে পারবে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকতে হবে। সর্বোপরি নিশ্চিত করতে হবে কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই সব ধরনের সেবাপ্রাপ্তি। কিন্তু সংজ্ঞা অনুযায়ী রাজধানী ঢাকায় এসবের অনুপস্থিতির জন্য একটি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে আমরা যে তথ্য পাই, ঢাকার অধিকাংশ স্কুলেই খেলার মাঠ নেই। শিশুর চলাচলের উপযোগী নয় শহরের পথঘাট। পার্ক থাকলেও তা ক্ষমতাবানদের দখলে। অথবা পার্কে এমন কিছু তৈরি করা, যা শিশুদের খেলার উপযোগী নয়। শিশুদের জন্য নেই নিরাপদ গণপরিবহনও। এর ওপর রয়েছে সর্বব্যাপী দূষণ, যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ করছে। এর সঙ্গে ঘরেও যেহেতু আমরা সন্তানকে সময় দিতে পারছি না ফলে শিশুদের সময় কাটে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে অথবা মোবাইল ফোন, ট্যাব, কম্পিউটারে গেমস খেলে।
সত্যিকার অর্থে অবস্থা দেখে-শুনে ভয় হয়— এ কোন ভয়ংকর ভবিষ্যতের দিকে আমরা ঠেলে দিচ্ছি আমাদের প্রজন্মকে? আমরা কি ভেবে দেখছি সময় আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কোথায় কোন পৃথিবী আমরা রেখে যাচ্ছি আমাদের সন্তানদের জন্য? আমরা তো আমাদের শিশু-কিশোরদের জন্য কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বলে যাওয়া সত্যিকার অর্থে বাসযোগ্য পৃথিবীর সন্ধান করছি না। তাদের সামনে সেই অঙ্গীকারও করছি না। ব্যক্তিগতভাবে যেমন, তেমনি রাষ্ট্রীয়ভাবেও শিশুদের জন্য সুস্থ পরিবেশ দেবার চেষ্টা করছি না। একটি শিশু-কিশোরের বেড়ে ওঠার পরিবেশে প্রতিপদে যে প্রতিবন্ধকতা, তাই তাদের ঠেলে দিচ্ছে এমন ভয়ংকর ভবিষ্যতের দিকে। আমাদের নীতি আর বিবেকহীনতাই নষ্ট করে দিচ্ছে শিশুদের শেষ ভরসার জায়গাগুলো।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আজ আমার সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখার যে ইচ্ছে, তা থেকেই সব শিশু-কিশোরের জন্য মায়া-মমতা আর ভালোবাসা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। যার শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠবে আমাদের সন্তান। সব জেনেও আমরা না জানার যে ভান করে চোখ বন্ধ রেখে ভাবছি— আমার সন্তান নিরাপদ থাকলেই হবে। অন্যের সন্তানের ভাবনা আমার না। এতে করে ক্ষতি আমরা ডেকে আনছি, ভবিষ্যতের সেই বিপদ মোকাবিলা করার সামর্থ্য কি আমাদের থাকবে?
আর তাই নতুন বছরে আমাদের সমাজপতি, রাজনীতিক, বিজ্ঞানী, চিন্তক-বিশ্লেষক— সর্বোপরি সরকারের কাছে বিশেষ অনুরোধ থাকবে, দেশের সার্বিক উন্নয়ন আগামী প্রজন্মকে ঘিরেই পরিচালিত হতে হবে। উন্নয়নের মহাসড়কে যখন দেশ, সেই উন্নয়নের সারথি করে নিতে হবে তরুণ প্রজন্মকে। তাদের জন্যই শিক্ষা, বাণিজ্য, অর্থনীতি, চাকরি-নিয়োগ প্রভৃতি যুগোপযোগী ও জনবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে। নতুন বছর হোক তারুণ্যের— এই কামনা করি।
লেখক : সাংবাদিক, কবি