মাছুম বিল্লাহ
পাঠ্যসূচি হলো শিক্ষাক্রমের অংশবিশেষ। শিক্ষাক্রম, শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণ এবং সামগ্রিক রূপরেখা। একটি দেশের শিক্ষাক্রম ও এর কাঠামো যে সব বিষয়ের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে সেগুলো হচ্ছে জাতীয় দর্শন, রাষ্ট্রীয় আদর্শ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামোগত অবস্থা, জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য, জাতিগত মূল্যবোধ, জনগনের ধর্মীয় চেতনা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত, জনগণের সমাকলীন জীবনব্যবস্থা, শিক্ষার্থীর সমাকালীন চাহিদা ও ভবিষ্যৎ, সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ও জরুরি চাহিদাসমূহ। আধুনিক শিক্ষাক্রমের প্রবক্তা Ralph Tzlor ১৯৫৬ সালে শিক্ষাক্রমের একটি ধারণা দেন। এর মূল কথা হচ্ছে- ‘শিক্ষার্থীদের সকল শিখন যা শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিদ্যালয়ের দ্বারা পরিকল্পিত ও পরিচালিত হয় তাই শিক্ষাক্রম।’ তিনি চারটি প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষাক্রমের ধারণাটি স্বচ্ছ করার চেষ্টা করেন। প্রশ্নগুলো হচ্ছে- (ক) শিক্ষা কী কী উদ্দেশ্য অর্জন করবে, (খ) কী কী শিখন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিদ্যালয় উল্লেখিত উদ্দেশ্য অর্জন করবে, (গ) এসব অভিজ্ঞতা কী উপায়ে সংগঠন ও বিন্যাস করা যাবে এবং ( ঘ) উদ্দেশ্যগুলো অর্জিত হয়েছে কি না তা কীভাবে যাচাই করা যাবে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য-বিষয়বস্তু-সংগঠন-মূল্যায়ন এই চারস্তর মডেল বলা হয়ে থাকে টেলরের ধারণাকে। ১৯৭০ সালে Mauritz Johnson বলেন, Curriculum is concerned not with what students will do in the learning situation, but with what they will learn as a consequence of what they do. Curriculum is concerned with results. ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) শিক্ষাক্রমের একটি ধারণ প্রদান করে। এতে শিখণ-শেখানো প্রক্রিয়াকে প্রাধ্যান্য দেয়া হয়। এখানে বলা হয়, A curriculum is an educational project defining : (ধ) the aims, goals and objectives of an educational action; (ন) the ways, means and activities employed to achieve these goals; (প) the methods and instruments required to evaluate the success of the action.
চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নিজে নিজে পড়তে ও লিখতে পারে তাই শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যপুস্তক ও বিভিন্ন সম্পূরক পঠন সামগ্রী থাকবে। পাঠ্যপুস্তক সহায়ক হলেও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দক্ষতা, মূল্যবোধ, গুণাবলি ও চেতনার বিকাশের জন্য তাদের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা ও হাতে কলমে কাজের মাধ্যমে যেতে হবে পাশাপাশি বিভিন্ন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। শিল্প ও সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে শিশুদের সৃজনশীল চিন্তার সঠিক বিকাশও মূল্যায়ন করা যায়। শিল্প ও সংস্কৃতি শিখন-ক্ষেত্রটিকে এমন একটি সমন্বিত বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেখানে শিল্প ও সংস্কৃতির বিভিন্ন সৃজনশীল ধারা চর্চার সুযোগ রয়েছে। একজন শিক্ষার্থী নান্দনিক, রুচিশীল ও শিল্পবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। শিক্ষার্থীর ইচ্ছা ও প্রয়োজনবোধে সৃজনশীল সক্ষমতাকে উচ্চতর শিক্ষা, কর্মজগৎ বা আত্মনির্ভরশীল হতে বিবেচনা করারও সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।
প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত গড় শিখন ঘণ্টা ৭৯৯ এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত গড় শিখন ঘণ্টা ৯১৯ ঘণ্টা। প্রচলিত ছুটির হিসেবকে বিবেচনায় রেখে মোট কর্মদিবস ১৮৫ দিন ধরা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শুক্রবার ও শনিবার দুইদিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে। দশম শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষায় বর্তমানে ৩২ কর্মদিবস প্রয়োজন হয়, নতুন শিক্ষাক্রমে বিষয় বিন্যাস ও মূল্যায়ন কৌশল পরিবর্তনের কারণে এ পরীক্ষা ৫ কর্মদিবসেই সম্পন্ন হবে। প্রাথমিক স্তরে এক্ষেত্রে আরো সময় বেশি পাওয়া যাবে। তাছাড়া বর্তমানে দুটি সাময়িক পরীক্ষার জন্য মোট ২৪ কর্মদিবস এর স্থলে নতুন শিক্ষাক্রমে মোট ১০ কর্মদিবস প্রয়োজন হবে। এছাড়া শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিবস, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস, জাতীয় শোক দিবস এবং বিজয় দিবস এই ৫টি জাতীয় দিবসের কার্যক্রম নতুন শিক্ষাক্রমে শিখন সময় (বাহির) এর অন্তর্ভুক্ত বিধায় এখানে কর্মদিবস হিসেবে ধরা হয়েছে। ৮৯ ওইসিডি ও এর সহযোগী দেশসমূহের বার্ষিক গড় স্কুল দিবস হলো ১৮৫ দিন এবং ইউরোপিয়ান ২৩টি দেশের বার্ষিক গড় স্কুল দিবস হলো ১৮১ দিন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে স্কুল কর্মদিবস বিভিন্ন, যেমন মেঘালয়ে ১৯২ দিন আবার মহারাষ্ট্রে ২০০ দিন। এই প্রেক্ষিতে সপ্তাহে দুইদিন ছুটি হিসেব করে প্রস্তাবিত মোট কর্মদিবস ও শিখন ঘন্টা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। ওইসিডি ও এর সহযোগী দেশসমূহে গড়ে প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষা, গণিত ও শিল্পকলা বিষয়ে মোট শিখন সময়ের ৫২% সময় বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু মাধ্যমিক স্তরে মাতৃভাষা, বিদেশি ভাষা ও গণিত বিষয়ের জন্য মোট শিখন সময়ের ৪২% সময় বরাদ্দ থাকে।
২০২২সালে নতুন পাঠক্রমের নতুন পাঠ্যবই পাবে প্রথম ও দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। ২০২৩ সালে পাবে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এবং ২০২৪ সালে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। আর এই ২০২৪ সাল থেকেই মাধ্যমিকে কলা, মানবিক ও বিজ্ঞান নামে বিভাজন থাকছে না। অনেক শিক্ষাবিদ বলেছেন যে, মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাগ বিভাজন না থাকায় শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ভাষা, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ও সাহিত্য সবই পড়তে হবে। মাধ্যমিক পাস করে একজন শিক্ষার্থী প্রায় সব রকমের জ্ঞান নিয়ে বের হবে। শিক্ষার্থী তাঁর আগ্রহ, সামর্থ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনটি বিশেষায়িত বিষয় নির্বাচন করতে পারবে। জীবন ও জীবিকা শিখন-ক্ষেত্রের আলোকে শিক্ষার্থীরা যেন আত্ম-কর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ হয় তার জন্য পেশাদারি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য প্রায়োগিক বিষয়সমূহ নির্বাচন করা যাবে।
প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়ন (১০০%) চতুর্থ থেকে পঞ্চম শিখনকালীন মূল্যায়ন শিখনকালীন মূল্যায়ন (৭০%) সামষ্টিক মূল্যায়ন (৩০%), ষষ্ঠ থেকে অষ্টম প্রেণি পর্যন্ত (৬০%) সামষ্টিক মূল্যায়ন (৪০%)। নবম-দশম শ্রেণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন (৫০%) সামষ্টিক মূল্যায়ন (৫০%) পাবলিক পরীক্ষা। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন (৩০%) সামষ্টিক মূল্যায়ন (৭০%) পাবলিক পরীক্ষা ৩টি আবশ্যিক বিষয়ে ৩০% শিখনকালীন মূল্যায়ন ও ৭০% সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। বিদ্যালয়ের প্রারম্ভিক সময়ে মাতৃভাষা, গণিত ও শিল্প সংস্কৃতি শিখনক্ষেত্রে মোট স্কুল শিখন সময়ের প্রায় ৬০% এবং প্রাথমিক স্তরে বাংলা, গণিত ও শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ে প্রায় ৫৬% শিখন সময় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পক্ষান্তরে, মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯ম-১০ম শ্রেণিতে মোট শিখন সময়ের প্রায় ৪৫% সময় বরাদ্দ করা হয়েছে ইংরেজি, সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান বিষয়ের জন্য। বিদ্যালয়ের প্রারম্ভিক সময়ে মাতৃভাষা, গণিত ও শিল্প সংস্কৃতি শিখনক্ষেত্রে শিশুদের অধিক সময় বরাদ্দ করা হয়েছে যা প্রাক-প্রাথমিকে মোট স্কুল শিখন সময়ের প্রায় ৬০% এবং প্রাথমিক স্তরে বাংলা, গণিত ও শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ে প্রায় ৫৬% শিখন সময় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পক্ষান্তরে, মাধ্যমিক পর্যায়ে নবম-দশম শ্রেণিতে মোট শিখন সময়ের প্রায় ৪৫% সময় বরাদ্দ করা হয়েছে ইংরেজি, সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান বিষয়ের জন্য।
মোটামুটি দশ বছর পর পর একটি দেশের কারিকুলাম পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। আমদের বর্তমানে প্রচলিত কারিকুলামটি ২০১২ সালি চালু করা হয়েছিল। আবার ২০২২ সালে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম নাগরিক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে যোগ্যতাভিত্তিক কারিকুলাম চালু করার প্রস্তুতি চলছে। এই কারিকুলামের সঠিক বাস্তবায়ন আশা করছি।
লেখক : গবেষক, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত
masumbillah65@gmail.com