• শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫ | ১৫ চৈত্র ১৪৩১ | ১৫ শাওয়াল ১৪৪৬

ধর্ম

ধূমপান : ইসলাম কী বলে

  • প্রকাশিত ১১ জুন, ২০২১

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

 

 

ধূমপান একটি মারাত্মক ব্যাধি, অত্যন্ত ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক রোগ। কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য বর্তমান দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ এ ধরনের একটি মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত। যারা ধূমপান করে তাদের যদি আপনি জিজ্ঞাসা করেন, ভাই ধূমপান কি ভালো জিনিস? সে অবশ্যই বলবে ‘না’। তাহলে ইসলাম কি ধূমপান সমর্থন করে? অনেকে এটার কারণ হিসেবে ধূমপান করাকে ইসলামে মাকরুহ বা অপছন্দনীয় হিসেবে আখ্যায়িত করে। আর বর্তমানে করোনা মহামারীতেও ধূমপায়ীদের করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। কারণ, ধূমপায়ীরা অপেক্ষাকৃত বেশি নাক-মুখ স্পর্শ করেন। আবার সংক্রমিত হওয়ার পর ধূমপায়ী রোগীদের জটিলতার আশঙ্কাও অধূমপায়ীদের তুলনায় তিনগুণ বেশি থাকে। করোনায় এই রোগীদের মৃত্যুহারও বেশি। তাছাড়া ধূমপানের ফলে যে শুধু তারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা নয়; বরং তাদের সংস্পর্শে থাকা অধূমপায়ীও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে ফুসফুসের নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

ধূমপান ও তামাক সেবন প্রয়োজনীয়ও নয় এবং উপকারীও নয়; বরং শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই এটি সম্পূর্ণ অপচয়ের শামিল। ইসলামী বিধানে অপচয় করা হারাম; অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না; নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই; আর শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা ইসরা, আয়াত-২৬, ২৭) এমন কোনো কাজকর্ম যা নিজেকে ধ্বংসের মধ্যে ফেলে বা অঙ্গহানি ঘটায় অথবা স্থায়ী ক্ষতি করে, তা সম্পূর্ণরূপে হারাম, নিষিদ্ধ ও নাজায়েজ। কারণ, মানুষ তার নিজের স্রষ্টাও নয় মালিকও নয়; সবকিছুর মালিক হলেন আল্লাহতায়ালা। আর মানুষ হলো তার আমানতদার বা হেফাজতকারী। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা নিজেদের হাতে নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না। তোমরা সৎ ও সুন্দর কাজ করো; নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা সৎকর্মপরায়ণ লোকদের ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৯৫)

ধূমপান ও তামাক একপর্যায়ে নেশায় পরিণত হয়, যা ছাড়া ধূমপায়ী ও মাদকসেবী থাকতে পারে না। ইসলামী শরিয়তে নেশা হারাম। জাহান্নাম বা দোজখের বৈশিষ্ট্য তিনটি- আগুন, ধোঁয়া ও দুর্গন্ধ। এই তিনটির সমাহার ঘটে ধূমপানে। সর্বোপরি ‘ধূমপান মাদক সেবনের সোপান’। ধূমপান ও তামাকের ক্ষতি সর্বগ্রাসী। ধূমপান ও তামাক শুধু ব্যবহারকারীর নয়, ব্যাপকভাবে অন্যদেরও ক্ষতি সাধন করে। এটি দেশ, জাতি ও সমাজ সভ্যতার চরম শত্রু। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সতর্ক থাকো এমন ফেতনা সম্পর্কে, যার ক্ষতিকর প্রভাব শুধু জালিম অপরাধী বিশেষের প্রতি আপতিত হবে না (বরং সামগ্রিকভাবে সবার ক্ষতি হবে)। আর জেনে রাখো নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা কঠোর প্রতিবিধানকারী।’ (সুরা আনফাল, আয়াত- ২৫) নিজের ক্ষতি করার যেমন এখতিয়ার নেই, তেমনি অন্যের ক্ষতি করাও জায়েজ নেই। একজন ধূমপায়ী ব্যক্তি নিজের ক্ষতির পাশাপাশি আশপাশের অন্যদেরও ক্ষতি করে থাকে, যা সম্পূর্ণ হারাম ও কবিরা গুনাহ।

যারা ধূমপান করে বা তামাক সেবন করে, তাদের মুখে ও শরীরে একধরনের উৎকট বিশ্রী দুর্গন্ধ ছড়ায়। যা পাশের মানুষের কষ্টের কারণ হয় এবং তা হারাম ও নাজায়েজ। যেহেতু বিড়ি-সিগারেট ও তামাকের কোনো উপকারিতা নেই এবং এর কোনো শরিয়াসম্মত বৈধ বা ইতিবাচক বা কল্যাণকর ব্যবহারও নেই; বরং এর মধ্যে কেবল ক্ষতিই নিহিত। তাই এর উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিক্রয় ও বিপণন কোনোটিই জায়েজ নয়। সুতরাং শুধু ধূমপান ও তামাক সেবন নয়; বরং তামাকসহ এর যাবতীয় উপকরণ উৎপাদন, মজুতকরণ ও সংরক্ষণ এবং বিপণন ও বিতরণ সবই বন্ধ করতে হবে। আর ধূমপান মত্যু ঘটায়। বিষয়টি জেনেও মানুষ নিজ হাতে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। জাতিসংঘের মাদক বিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধূমপানের কারণে প্রতিবছর বিশ্বে ৫০ লাখ মানুষ মারা যায়। এর পরও মানুষ ধূমপান ছাড়তে রাজি নয়। অথচ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘(তোমরা) নিজের হাতে নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৯৫) এই আয়াতে সরাসরি ধূমপানের কথা উল্লেখ না থাকলেও ধূমপান এমন একটি কাজ, যার মাধ্যমে মানুষ নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।

অনেকে যুক্তি দিয়ে থাকেন, ধূমপান করে সবাই তো আর মারা যায় না।  হ্যাঁ, সব ধূমপায়ী ধূমপানের প্রথম পুরস্কার মৃত্যু উপহার না পেলেও এর পরের পুরস্কারগুলো ঠিকই পান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সর্বজনীনভাবে এটি স্বীকৃত যে, ধূমপান যক্ষ্মা, ফুসফুসের ক্যান্সারসহ নানা রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া ধূমপানে রয়েছে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি। ধূমপান ত্বকের একদম বাইরের দিকের ধমনিগুলোতে রক্ত সঞ্চালন কমিয়ে দেয়। ফলে ত্বকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনটুকুও পৌঁছায় না। যা অল্প বয়সেই মানুষকে বুড়ো বানিয়ে দেয়। এ ছাড়া সিগারেটের তামাকে থাকে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, যা মানুষের ত্বকের এলাস্টিন এবং কোলাজেনকে নষ্ট করে দেয়। সে কারণেই ধূমপায়ীদের ত্বকে বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সিগারেটের নিকোটিনের কারণে দাঁতের ঝকঝকে সাদা রং পালটে হলদেটে হয়ে যায়। ধূমপানের ফলে চুলেরও ক্ষতি হয়। গবেষণায় জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে যারা ধূমপান করছেন তাঁদের চুল বাকিদের তুলনায় অনেক পাতলা হয়। কারণ সিগারেট চুলের ডিএনএগুলোকে নষ্ট করে দেয়। ধূমপানের ফলে চোখের তলায় কালি, ‘ব্ল্যাকহেডস’-এর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে হিমোগ্লোবিন বেশি পরিমাণে অক্সিজেন বহনে অক্ষম হয়ে পড়ে। যে কারণে শরীরের ক্ষত সারতেও অধিক সময় লাগে। পরিশেষে,  আসুন আমরা সবাই মিলে একটি ধূমপান মুক্ত পরিবেশ ও সমাজ গড়ি। বেশি বেশি কালামে পাকের তেলাওয়াত করি। বেশি বেশি নেক আমল করি। খারাপ পরিবেশ ও খারাপ সঙ্গ ত্যাগ করি। আল্লাহওয়ালা ও আলেম-উলামাদের কাছে যাতায়াত করি। ইনশাআল্লাহ আমাদের থেকে মহান রব্বুল আলামিন সব খারাপ অভ্যাস দূর করে দেবেন। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে তামাক ও ধূমপানমুক্ত সমাজ গড়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।

 

লেখক : স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক

সবুজ আন্দোলন কার্যনির্বাহী পরিষদ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads