সারা দেশে বোরো ধান কাটার উৎসব চলছে। একদিকে ফণীর প্রভাব অন্যদিকে ধানের ফলনে বিপর্যয়ে দিশাহারা কৃষক। অনেক জেলা থেকে ধানের বাম্পার ফলনের খবর এলেও তা ম্লান হয়ে যাচ্ছে মজুরির কারণে। এ ছাড়া সরকারের ধানের দাম নির্ধারণের বিষয়েও কৃষকের ক্ষোভ রয়েছে। অনেক কৃষক জানাচ্ছেন, ধান চাষের খরচ থেকে কাটার মজুরি পর্যন্ত মোট যে খরচ হয়, তা ধান বিক্রি করে আসছে না। ফলে তারা বোরো চাষে অনাগ্রহের কথা জানান। আগামীতে ধানের বদলে অন্য ফসল চাষের কথা জানান তারা।
আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠোনো খবর—
মিলারদের সিন্ডিকেটে নওগাঁর ধানের বাজারে ধস : ফণীর প্রভাব ও ধানের ফলনে বিপর্যয় পেরিয়ে সর্বশেষ মিলারদের সিন্ডিকেটের কারণে নওগাঁয় ধানের ব্যাপক দরপতনে দিশাহারা কৃষক। প্রতি মণ ধান ৭৫০ টাকায় কেনা হলেও নতুন ধান ওঠার পর তা নেমে এসেছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা মণ দরে।
এর জন্য কৃষক ও হাসকিং মিলারের মালিকরা অটোমেটিক মিলারদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন। আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, হাসকিং ও অটোমেটিক মিলারদের বরাদ্দতে সমন্বয়ের অভাব।
জানা গেছে, ধান-চাল উৎপাদনের বৃহত্তর জেলা নওগাঁ। সারা দেশের মতো নওগাঁয় ফণীর প্রভাব পড়েছিল গত কয়েক দিন আগে। এতে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। একদিকে উৎপাদন কম, অন্যদিকে শ্রমিকের মূল্য বৃদ্ধি এবং বাজারে ধানের দাম কম হওয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়ে কৃষক। তবে ধানের দাম কম হওয়ায় পেছনে অটোমেটিক রাইস মিলারদের সিন্ডিকেটকে দুষছেন কৃষক, হাসকিং মিলার ও ব্যবসায়ীরা। শুধু তাই নয়, কৃষকরা সম্প্র্রতি ধানের ন্যায্যমূল্য নিয়ে জেলার ধামইরহাটে মানববন্ধনও করেছে।
নওগাঁ সদর উপজেলার দরিদ্র কৃষক ভোলা। তিনি গত সোমবার বিকালে নওগাঁ সদরের মাতাসাগর হাটে ধান বিক্রি করতে এসেছিলেন। তিনি ধান লাগানো থেকে শুরু করে বিক্রি পর্যন্ত প্রতি বিঘা জমির লাভ-লোকসানের হিসাব দেন। তার প্রতি বিঘায় লাগানো থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১৬ হাজার টাকা আর ধান পেয়েছেন ২২ মণ। ৫০০ টাকা দরে বিক্রি করে দাম পেয়েছেন ১২ হাজার টাকা। এতে তার প্রতি বিঘায় লোকসান হয়েছে ৪ হাজার টাকা। আরেক কৃষক লুৎফর রহমান বলেন, বর্তমান ধানের বাজারমূল্যে প্রতি বিঘায় ৪ হাজার টাকা লোকসান। প্রতি বিঘায় ফলন ভালো হলেও বাজারে ধানের দাম নেই। মাতাসাগর হাটের ইজারদার উজ্জ্বল হোসেন বলেন, বাজারে ধানের ক্রেতা নেই। কারণ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করার কারণে বাজারের এ অবস্থা।
নওগাঁর ফারিহা রাইস মিলের মালিক শেখ ফরিদ এবং বিসমিল্লাহ মিলের মালিক শাহাদত হোসেন বলেন, ধানের দাম কম হওয়ার পেছনে হাসকিং ও অটোমেটিক রাইস মিলের বরাদ্দের সমন্বয়হীনতায় মূল কারণ। হাসকিং মিলারদের বরাদ্দ কম হওয়ায় তারা বাজারে ধান কিনছেন না। ফলে বাজারে ক্রেতা কম হওয়ায় ধানের দাম কম।
জেলা চাল-কল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ চকদার সিন্ডিকেটের বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ধানের দাম পেতে হলে ক্রেতা বৃদ্ধি করতে হবে। আর এজন্য হাসকিং মিলারদের বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
হাসি নেই বাগেরহাটের কৃষকের মুখে : বাগেরহাটে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপাদন হলেও হাসি নেই কৃষকের মুখে। ৯৮ শতাংশ কৃষকদের ধান কাটা ও মাড়াই সম্পন্ন হলেও সরকারিভাবে এখনো ধান কেনা শুরু করতে পারেনি খাদ্য বিভাগ। রক্ত পানি করে উৎপাদিত এ ধান নিয়ে এখন বিপাকে পড়েছেন বাগেরহাটের প্রান্তিক কৃষকরা। বাধ্য হয়ে উৎপাদন খরচের থেকে কম দামে মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে ধান বিক্রি করছেন কৃষকরা। লোকসান হওয়ায় অনেক কৃষকই ধান চাষের আগ্রহ হারাচ্ছেন।
বোরো মৌসুমে জেলায় ৫৬ হাজার হেক্টর জমিতে কৃষি বিভাগের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৬২ হাজার ৯৯৫ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ৯০ হাজার ৯৩০ মেট্রিক টন। তবে সরকারিভাবে ধান কেনা হবে মাত্র ১৮৫৫ মেট্রিক টন। হিসাব অনুযায়ী মোট উৎপাদনের ২ দশমিক ১০ শতাংশ ধান কিনছে সরকার। ফলে সব কৃষক সরকারের কাছে ধান বিক্রি করার সুযোগ পাবেন না। হতাশ কৃষকরা অনেকেই ধান চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
সম্প্রতি ফকিরহাট উপজেলার অর্গানিক বেতাগা কৃষিপণ্য সংগ্রহ ও বিপণন কেন্দ্রে দেখা যায়, কৃষকরা ৪৪০ থেকে ৬৫০ টাকায় ধান বিক্রি করছেন। এ দামে খুশি নয় কৃষকরা। অল্প দামে ধান ক্রয় করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও ফড়িয়া।
ধান বিক্রি করতে আসা কৃষক গুরুদাস, মজনু মোল্লা, হারুন মোড়ল, আনিস ফকিরসহ কয়েকজন বলেন, প্রতি মণ ধান বিক্রি করছি ৪৪০ থেকে ৬৫০ টাকা। কিন্তু জমিতে ধান রোপণ, আগাছা পরিষ্কার, সার-কীটনাশক প্রয়োগ, ধান কাটা, মাড়াই ও ঘরে তোলায় প্রতি মণ ধানে কৃষকদের যে খরচ হয় তাও বিক্রি করে তুলতে পারছি না। এছাড়া ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য শ্রমিকের মজুরি দিতে হচ্ছে ৭০০ টাকা, যা খুবই কষ্টকর।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আফতাব উদ্দিন বলেন, জেলায় ২ লাখ ৪৩ হাজার ৬৭ জন কৃষককে আমরা কৃষিকার্ড দিয়েছি। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা সংগ্রহ ও মনিটরিং কমিটি কৃষিকার্ডপ্রাপ্ত কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করবেন।
জেলা সংগ্রহ ও মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব ও জেলা খাদ্য কর্মকর্তা একেএম শহিদুল হক বলেন, এ মৌসুমে বাগেরহাট থেকে ১ হাজার ৪০ টাকা মণে ১ হাজার ৮৫৫ মেট্রিক টন ধান কেনা হবে। দু-এক দিনের মধ্যে আমাদের ধান কেনা শুরু যাবে।
রাজশাহীতে সমাবেশ ও মানববন্ধন : বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন রাজশাহী মহানগর শাখার উদ্যোগে মহানগরের সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এ সময় তাদের স্লোগান ছিল ‘কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য দাও, কৃষক বাঁচাও।’
কর্মসূচি চলাকালে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন রাজশাহী মহানগরের নেতারা বলেন, কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। কালোবাজারি ও মধ্যস্থতাকারী সুবিধাভোগী গোষ্ঠীকে বিলুপ্ত করে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে হবে এবং সরকারি নীতি কৃষকবান্ধব করতে হবে। তা না হলে সবাইকে নিয়ে শিগগিরই কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
নেত্রকোনায় শ্রমিক সঙ্কটে মাঠে নারী-শিশু : চলতি মৌসুমে ধানের ফলন ভালো হলেও বাজারে দাম কম। অন্যদিকে অতিরিক্ত পারিশ্রমিকের দাবিতে সৃষ্টি হয়েছে শ্রমিক সঙ্কট। এ অবস্থায় কোনো উপায় না পেয়ে ঘরে ফসল তুলতে শ্রমিকের কাজ করতে মাঠে নেমে পড়েছে ঘরের নারী-শিশুরা।
ষষ্ঠ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আলিম ও নাজিম উদ্দিন। তারা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার বাকলজোড়া ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের রহিম উদ্দিনের ছেলে। বাবার সঙ্গে ধান কেটে ঠেলাগাড়িতে তুলে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় তাদের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানায়, বাবাকে বলতে শুনেছি বাজারে প্রতি মণ ধানের দাম মাত্র ৪০০ টাকা। আর আড়াই মণ ধানের দাম (১ হাজার টাকা) দিয়ে একজন শ্রমিক নেওয়া সম্ভব নয়। তাই মা-বাবা আর আমরা নিজেরাই মাঠে নেমেছি।
একই গ্রামের কৃষক ইলিয়াস মিয়া বলেন, মাত্রাতিরিক্ত পারিশ্রমিক দাবিতে শ্রমিক সঙ্কট ও বাজারে ধানের ন্যায্যমূল্য না থাকায় লোকসানে পড়ে দিগভ্রান্ত হয়ে পড়েছে কৃষকেরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পূর্বধলা উপজেলার ধলামূলগাঁও গ্রামের এক গৃহবধূ বলেন, শ্বশুরবাড়িতে এসে রাস্তা দিয়ে কোনোদিন ঠেলাগাড়িতে ধান টেনে নিতে হয়নি। পরিস্থিতি আজ এখানে নিয়ে এসেছে। যে পরিমাণ পারিশ্রমিক শ্রমিকদের দাবি আর বাজারে ধানের যে দাম তাতে শ্রমিক দিয়ে ধান কাটালে কৃষক বাঁচবে না।
রংপুরে মহাসড়কে ধান ঢেলে প্রতিবাদ : ধানের ন্যায্যমূল্যে বিপর্যয়ের প্রতিবাদে এবার রংপুর মহাসড়কে ধান ঢেলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা। অতিদ্রুত ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা না হলে আগামীতে ধান চাষ না করার শপথ নেন তারা।
গতকাল দুপুরে কৃষক সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে নগরীর সাতমাথায় ঢাকা-লালমনিরহাট মহাসড়কে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কর্মসূচিতে কৃষকরা সরকারি ব্যবস্থাপনায় হাটে হাটে ক্রয়কেন্দ্র খোলার দাবি জানান।
প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা বলেন, বর্তমানে একজন শ্রমিকের মজুরির চেয়ে এক মণ ধানের দাম এখন কম, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ধান চাষ করে উৎপাদন ব্যয়ের অর্ধেকও উঠছে না। এভাবে চলতে থাকলে কৃষকের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
কুষ্টিয়ায় ধান বিক্রি করে লেবার খরচ উঠছে না : ধানের যে দাম, এক মণ ধান বিক্রি করে একটা লেবার খরচও হচ্ছে না। সাড়ে ৫০০ টাকা মণ ধান আর ধান কাটা লেবারের মজুরি ৬০০-৭০০ টাকা। তাও হাতে পায়ে ধরে আনতে হচ্ছে তাদের। কী করা, ধান যেহেতু চাষ করেছি কাটতে তো হবেই। খাওয়ার জন্য আবাদ করেছি, না কাটলেও তো হয় না। আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা ইউনিয়নের কৃষক বদর উদ্দিন। গত বুধবার দুুপুরে মিরপুর উপজেলার আমলা মাঠে ধান কাটার সময় এভাবে আক্ষেপ করেন তিনি। তিনি বলেন, ধানের দাম প্রতিবছরই বাড়ে, এবারো বাড়তে পারে তবে যখন আমার মতো কৃষকের ঘরে ধান থাকবে না তখন। সরকারের কাছ থেকে আজীবন লাভ করে মিল মালিকরা আর ব্যবসায়ীরা। আর আমরা কৃষক আজীবন কাজ করেই মরব। আমাদের কেনার সময় সারের দাম বেশি, বীজের দাম বেশি, কীটনাশকের দাম বেশি, শুধু বিক্রির সময় দাম কম। চালের দাম বাড়ে আর ধানের দাম কমে। আমরা ধান লাগিয়ে পড়েছি মহা বিপদে।
সিরাজুল ইসলাম নামে অপর এক কৃষক বলেন, চাষিদের পদে পদে বিপদ। সার, বীজ, কীটনাশক সবকিছুরই দাম চড়া। এমনকি ধানের চালেরও দাম বেশি সে তুলনায় ধানের ন্যূনতম ন্যায্যমূল্যটুকুও নেই। প্রতি বিঘা ধান উৎপাদন করতে যে খরচ হয়, বর্তমানে ধান বিক্রি করে তার লেবার খরচই উঠছে না।
মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, এ বছর ধানের উৎপাদন অনেক বেশি হয়েছে। এ সময় কৃষকরা শ্রমিক না পাওয়ায় অতিরিক্ত মজুরি দিতে হচ্ছে। ধানের ফলন ভালো হলেও কৃষকেরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। দাম না পেলে কষ্ট করে ধান আবাদ করা থেকে তারা বিমুখ হবেন। বাজার মন্দার বিষয়টি খতিয়ে দেখা জরুরি।