ধানে ধন্য বাংলাদেশ

সংগৃহীত ছবি

কৃষি অর্থনীতি

ধানে ধন্য বাংলাদেশ

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের সমৃদ্ধির অন্যতম উৎস ধান। দেশে স্বাধীনতার আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে উৎপাদন স্বল্পতার কারণে বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানি করে রেশনে দেয়া হতো। স্বাধীনতাকালে এদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। বাংলাদেশে বর্তমান জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হতো, এখনো সেই একই পরিমাণ ধান উৎপাদিত হলে, এই দ্বিগুণ জনসংখ্যার অবস্থাটা কী হতো ভাবা যায়! ১৯৭০ সালে দেশে চাল উৎপাদিত হয়েছিল প্রায় এক কোটি টনের মতো। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণার সফলতার কারণে নতুন নতুন উন্নত জাতের ধান উদ্ভাবনের হওয়ার ফলে ৪ কোটি টন ধান উৎপাদন সম্ভাবনার পথে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিভিন্ন ঘাতসহিষ্ণু ধান উদ্ভাবন হওয়ায় চাষের জমি বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৮২ মিলিয়ন হেক্টর। বর্তমানে দেশে যেসব ধান উৎপাদিত হচ্ছে তার ৮০ ভাগ ধানই এসব উন্নত জাতের। ফসলের আগাছা নির্মূল, ধান কাটা, মাড়াই ও ঝাড়ার কাজ, বীজ বপন, সার ও কীটনাশক ছিটানো প্রভৃতি কাজের জন্য ব্রির গবেষণা বিভাগের নেতৃত্বে আধুনিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছে। সবমিলিয়ে কৃষির অন্যতম সাফল্য হলো- দেশে ধান উৎপাদনে এসেছে বিপ্লব।

উৎপাদন নতুন বিপ্লব

একথা অনস্বীকার্য যে, কৃষিক্ষেত্রের সাফল্যের নেপথ্যে ধান গবেষণায় বিজ্ঞানীদের নিরলস শ্রম, আবিষ্কৃত নতুন ধান আবাদে মাঠ সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের চেষ্টা, কৃষকদের আর্থিক সহায়তা, সুষম সার ব্যবস্থাপনা সর্বোপরি সাফল্যের নেপথ্যে কাজ করেছেন বাংলার কৃষক। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ।  স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যেও প্রচণ্ড খাদ্যাভাব ছিল। সাড়ে চার দশকের ব্যবধানে বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটির অধিক, আবাদি জমি অনেক কমার পরও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। বিভিন্ন জাতের চাল রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। দেশের বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে উদ্ভাবিত ৮০টি নতুন জাতের ধান অঞ্চলভিত্তিক চাষাবাদে অভাবনীয় সাফল্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)-এর আশাবাদ অচিরেই ৪ কোটি টন ধান উৎপাদন সম্ভাবনার পথে বাংলাদেশ। ব্রির তথ্য অনুযায়ী, দেশে এ পর্যন্ত চারটি হাইব্রিডসহ ৭২টি উফশী ধানের জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। উন্নত জাতের ধানের মধ্যে ৮ থেকে ৯ টন পর্যন্ত ফলন দিতে পারে ৫টি জাত। ৮টি জাতের উৎপাদন ক্ষমতা ৬ থেকে ৭ টনের বেশি। হেক্টরপ্রতি ৫ টন উৎপাদন হয় ১২টি জাতের ধান। হেক্টরপ্রতি ৩ টনের বেশি উৎপাদন দেয় ৩টি জাত।

উদ্ভাবনে সাফল্য আর সাফল্য

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রতিকূলতা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা ৭টি লবণসহিষ্ণু, ২টি জলমগ্নতাসহিষ্ণু, ৪টি খরাসহিষ্ণু এবং ২টি শীতসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে দেশের ৮০ শতাংশ জমিতে ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাতের চাষাবাদ হয় এবং এ থেকে আসে দেশের মোট ধান উৎপাদনের ৯১ শতাংশ। আশার খবরটি হলো, বিশ্বে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল এবং কম সময়ে উৎপাদনশীল দস্তা বা জিংকসমৃদ্ধ আমন ধানের নতুন জাত ব্রি-৬২ অবমুক্ত করেছে বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়। এই ধানের প্রতি কেজি চালে ১৯ মিলিগ্রাম দস্তা বা জিংক এবং ৯ শতাংশ প্রোটিন থাকবে, যা পুষ্টিগুণ নিশ্চিত করবে এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করবে। ব্রি-৬২ ফলন দেবে ১০৫ দিনে। প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হবে চার দশমিক দুই টন ধান। তাছাড়া বিনা-১১ ও ১২ জলমগ্নসহিষ্ণু ধানের জাতটি ২৫ দিন পর্যন্ত পানির নিচে ডুবে থাকলেও টিকতে পারবে।  প্রতি হেক্টরে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ টন উৎপাদন হবে। অনুরূপ বিনা-১৩ সুগন্ধি জাতের আমন ধান ১৩৮ থেকে ১৪২ দিনে ঘরে তোলা সম্ভব। ফলন হবে হেক্টরপ্রতি চার থেকে সোয়া চার টন। দেশের হাওর এলাকার এই জাতের ধান নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।  আবার বিআরআই উদ্ভাবিত ব্রি-৫৯ উফশী জাতের বৈশিষ্ট্যশীল এবং ১৫৩ দিনের মধ্যে ফলনশীল এই ধানের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হবে সাড়ে সাত টন। ব্রি-৬০ লবণাক্ততা সহনীয় ধান ১৫০ দিনের মধ্যে লবণাক্ততার মাত্রাভেদে হেক্টর প্রতি ফলন হবে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে সাত টন পর্যন্ত। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক উদ্ভাবিত নারিকা জাতের ধান খরা মৌসুমেও ভালো ফলন দেয়। জানা গেছে, ভিয়েতনাম থেকে আমন মৌসুমের জন্য আরো পাঁচটি উচ্চফলনশীল নতুন জাতের ধানের বীজ আনা হয়েছে। মাত্র ৯০ থেকে ৯৫ দিনে এ জাতের ধানগুলোর ফসল ঘরে তোলা সম্ভব। এর আগে বাংলাদেশে উদ্ভাবিত বাংলামতি সুগন্ধি ধান ইতোমধ্যেই দেশজুড়ে কৃষকের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। মঙ্গা এলাকায় ব্রি-৩৩ ও ৩৯ জাতের ধান আবাদ করে মানুষের খাদ্য সংকট এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আগাম জাতে এ ধান কেটে একই জমিতে রবিশস্য করাও সম্ভব হচ্ছে। ব্রি-৪২ ও ৪৩ খরাসহিষ্ণু উফশী জাতের বোনা আউশ ধান বিশেষত খরা ও বৃষ্টিবহুল এলাকায় যেমন- ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা এলাকায় ধান ছিটিয়ে এবং ডাবলিং পদ্ধতিতে বপন করে ভালো ফলন পাওয়া গেছে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য হাই অ্যামাইলোজযুক্ত, রক্তশূন্যতা পূরণে সহায়ক অধিক আয়রনযুক্ত, ডায়রিয়া নিরোধে সহায়ক জিংকযুক্ত এবং রাতকানা রোগ নিরোধে সহায়ক ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে দেশের বিজ্ঞানীরা।

বিনা সেচে ধান : ২০০ কোটি টাকা সাশ্রয়

রংপুর অঞ্চলে সাড়ে ৪ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধান বিনা সেচে আবাদ হয়েছে। ফলে কৃষকদের প্রায় সোয়া ২০০ কোটি টাকা আর্থিক সাশ্রয় হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। বলা হচ্ছে, আবহাওয়া ধান চাষের অনুকূলে থাকায় এবার ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৬১৩ হেক্টর জমির মধ্যে মাত্র ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৯৪ হেক্টর জমিতে কৃষকরা সেচ দিয়ে আবাদ করেছে। বাকি ৪ লাখ ৬৭ হাজার ১১৯ হেক্টর জমি ছিল সেচ আওতার বাইরে। কৃষি অফিসের তথ্যমতে, প্রতি হেক্টর জমিতে কৃষকদের সেচ বাবদ খরচ পড়ে সাড়ে ৪ হাজার টাকার মতো। সেচের আওতার বাইরে যেসব জমিতে আবাদ হয়েছে সেই জমিগুলোতে সেচ দিলে কৃষকদের বাড়তি ব্যয় হতো ২১০ কোটি টাকা। তাহলে প্রকৃতি আমন ধানের পক্ষে থাকায় কৃষকদের ওই টাকা সাশ্রয় হয়েছে। 

উৎপাদন হবে ৫০ লাখ টন বাড়তি ধান

কৃষিবিদদের মতে, দেশে আবাদযোগ্য পতিত জমিসহ উপকূল ও হাওর অঞ্চলের জলাবদ্ধ একফসলি জমিকে দুই বা তিনফসলি জমিতে পরিণত করতে পারলে বছরে ৫০ লাখ টন বাড়তি খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব। মতানুযায়ী, দেশের বিস্তীর্ণ জলাবদ্ধ এলাকা চাষের আওতায় আনার পাশাপাশি জলাবদ্ধসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করা গেলে বছরে আরো ৫ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হবে। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাসেডের জরিপ রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে ৯০ লাখ ৯৪ হাজার হেক্টর জমি আবাদযোগ্য থাকলেও চাষ হয় ৮২ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে। এই জমির মধ্যে একফসলি জমির পরিমাণ ১৮ লাখ ৫৫ হাজার, দুইফসলি জমি ৪৪ লাখ ৪২ হাজার, তিনফসলি জমি ১৮ লাখ ৭১ হাজার হেক্টর। তিন ফসলের অধিক ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে চাষযোগ্য পতিত ৩ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর এবং চলতি পতিত ৪ লাখ ৭ হেক্টর জমি চাষের আওতায় আসছে না। কৃষি বিভাগের গবেষণায় বলা হয়, শুধু সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে একফসলি প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমিকে দুই বা তিনফসলি জমিতে রূপান্তর করা যাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, উৎপাদন বাড়ানো লক্ষ্যে পরিত্যক্ত ও পতিত প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমি ফসল চাষের আওতায় আনা হয়েছে। উপকূলীয় ১৪ জেলার আবাদযোগ্য ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৮১ হেক্টর চলতি পতিত জমি চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গবেষকদের ধারণা, কৃষি উপকরণের পর্যাপ্ত ও সুষ্ঠু ব্যবহার করা সম্ভব হলে উৎপাদন ৩০ শতাংশ বাড়বে।

দক্ষিণাঞ্চলে অনেক চরের জমি অনাবাদি পড়ে আছে। হাওরাঞ্চলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল শুধুই ঘাসের চট্টন হিসেবে পড়ে থাকে। পরিকল্পনামাফিক এই জমিগুলো আবাদ করার উদ্যোগ নিয়ে  এসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগালে ধান উৎপাদনে বিশ্বকে নতুন পথের সন্ধান দেবে বাংলাদেশ।

লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক, কলাম লেখক এবং উন্নয়ন গবেষক, ৎিরঃবঃড়সঁশঁষ৩৬—মসধরষ.পড়স

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads