রাজধানীর মিরপুরের পল্লবীতে সাড়ে পাঁচ বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গত ১৩ অক্টোবর বুধবার বিকেলে এ ঘটনা ঘটে। রাতে বিষয়টি পুলিশকে জানান স্বজনরা। ধর্ষক জিয়াউর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনে পরিবারের সঙ্গে থাকে ওই শিশু। তার বাবা-মা শ্রমজীবী। বাবা-মা কাজে বাইরে ছিলেন। এ সময় ওই বাসায় সাবলেট থাকা জিয়াউর রহমান কৌশলে শিশুটিকে নিজের ঘরে ডেকে নেয়। এরপর তার ওপর নির্যাতন চালায়। সন্ধ্যায় বাবা-মা বাসায় ফিরলে শিশুটি কাঁদতে থাকে। তারা কান্নার কারণ জানতে চাইলে সে ঘটনাটির ব্যাপারে জানায়। তখন ভুক্তভোগী শিশুর স্বজনরা প্রতিবেশীদের সহায়তায় ধর্ষককে আটকে রাখেন। পরে তারা থানায় এসে মামলা করেন। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভুক্তভোগী শিশুর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
গণমাধ্যমে এখন প্রতিনিয়তই নারী নির্যাতনের খবর চোখে পড়ে। নোয়াখালীতে নারী নির্যাতন, সিলেটের এমসি কলেজে তুলে নিয়ে ধর্ষণসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়নের ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলছে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে। ধর্ষণের অপরাধে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে বিচার ও রায় কার্যকর করার জন্য আইন সংশোধনের দাবি করে আসছে বিভিন্ন সংগঠন। একের পর এক যৌন নিপীড়নের ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের মধ্যে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। গত ১৩ অক্টোবর থেকে এটি আইনে পরিণত হয়েছে। এই মুহূর্তে জাতীয় সংসদের অধিবেশন না থাকায় রাষ্ট্রপতি এটিকে অধ্যাদেশ আকারে জারি করেছেন। বিদ্যমান আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন। সেটিকে এখন মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন করা হয়েছে।
বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। পাশাপাশি দুই ক্ষেত্রেই অর্থ দণ্ডের বিধান রয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৯৫২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ধর্ষণের পর মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। আর এই নয় মাসে ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৯২ জন নারী এবং ৯ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। তবে অনেক অভিযোগ থানা পর্যন্ত না পৌঁছানোয় প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে অধিকারকর্মীদের ধারণা। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে ধর্ষণের ঘটনায় ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার থেকে মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৫৪১টি। এর মধ্যে আসামির শাস্তি হয়েছে মাত্র ৬০টি ঘটনায়। এসব কারণে ধর্ষণের অপরাধে শাস্তির মাত্রা বাড়ানোর দাবি জোরালো হতে থাকে দেশের সব মহল থেকে।
২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যুর শাস্তি প্রসঙ্গে ৯-এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি এতদিন ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা দল বেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা আহত হলে, সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সেইসঙ্গে উভয় ক্ষেত্রেই ন্যূনতম এক লক্ষ টাকা করে অর্থ দণ্ডের বিধানও রয়েছে। সেই আইনেই পরিবর্তন এনে ধর্ষণ প্রমাণিত হলেই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হয়েছে। সেইসঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধানও থাকছে।
ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধনী এনে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ’ রাষ্ট্রপতির সম্মতিতে জারি করেছে সরকার। গত ১৩ অক্টোবর আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ থেকে এই অধ্যাদেশ জারি করা হয়। দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১২ অক্টোবর ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকে বিদ্যমান আইনের একটি ধারা সংশোধন করে ধর্ষণে সশ্রম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ছাড়াও মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়। বর্তমানে সংসদ অধিবেশন না থাকায় ১৩ অক্টোবর এই অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
২০০০ সালের ৮ নম্বর আইনের ধারা ৯ সংশোধনের জন্য জারি করা অধ্যাদেশে বলা হয়, ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হবে। অধ্যাদেশে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির ডিএনএ পরীক্ষার বিষয়ে বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির ধারা ৩২-এর অধীন মেডিকেল পরীক্ষা ছাড়াও উক্ত ব্যক্তির সম্মতি থাকুক বা না থাকুক, ডিএনএ আইন, ২০১৪ (২০১৪ সালের ১০ নং আইন)-এর বিধান অনুযায়ী ডিএনএ পরীক্ষা করতে হবে।
আইনের ধারা ৯-এর (১)-এ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড প্রতিস্থাপিত হবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। আইনের ১১ (গ) এবং ২০ (৭) ধারা সংশোধন করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘ধর্ষণ ছাড়া সাধারণ জখম হলে কম্পাউন্ড (আপসযোগ্য) করা যাবে। আর চিলড্রেন অ্যাক্ট, ১৯৭৪ প্রযোজ্য হবে না। এখন শিশু আইন, ২০১৩ প্রযোজ্য হবে।’ মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরো বলেন, ‘১৮০ দিনের মধ্যে মামলার বিচার শেষ করতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচার হবে। যদি কোনো বিচারক চলে যান, তাহলে তিনি যে অবস্থায় মামলা রেখে গেছেন, সেই অবস্থা থেকে পরবর্তীতে বিচার হবে।’ এটার একটা পজিটিভ ইমপ্যাক্ট আসবে। যারা অপরাধ করবে তারা অন্তত চিন্তা করবে যে, এটাতে তো মৃত্যুদণ্ড আছে, এখন তো আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড না।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সাত দিন থেকে এক মাস এবং মামলা নিষ্পত্তির জন্য ১৮০ দিন (ছয় মাস) সময় বেঁধে দেওয়া থাকলেও বাস্তবে ওই সময়ের মধ্যে রায় দেওয়া সম্ভব হয় না। ধর্ষণের বেশির ভাগ মামলা বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় ধামাচাপা পড়ে যায়। তা ছাড়া ঠিকমতো ডাক্তারি পরীক্ষা না হওয়া, সামাজিক সচেতনতার অভাব, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপসহ নানা কারণে বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যার কারণে আইন সংশোধনের দাবি ওঠে।
এদিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সাক্ষ্য বিবেচনায় এখন থেকে ধর্ষণ মামলায় আসামিকে সাজা দেওয়া যাবে। ধর্ষণ প্রমাণে মেডিকেল রিপোর্ট মুখ্য নয়। পাশাপাশি কোনো ভুক্তভোগী দেরিতে মামলা করলে সেটিকে মিথ্যা বলা যাবে না। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় নিম্ন আদালতের যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত এক আসামির সাজা বহাল রেখে সম্প্রতি এই রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, ধর্ষণ মামলায় মেডিকেল রিপোর্ট মুখ্য নয়, ভুক্তভোগীর মৌখিক ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের মাধ্যমে আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলেও সাজা দেওয়া যাবে।
২০০৬ সালে ধর্ষণের শিকার খুলনার দাকোপ থানার ১৫ বছর বয়সি তাসলিমা মামলা থানায় করতে যায়। কিন্তু তাকে সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ভুক্তভোগীর বাবা আদালতে মামলা করেন। তার মেডিকেল পরীক্ষা ছিল না। খুলনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সাজা বহাল রেখে দুজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বছর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এ রায় দেন। গত ১৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ওই রায়ের ১৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়। রায়ে বলা হয়, শুধু ডাক্তারি পরীক্ষা না হওয়ার কারণে ধর্ষণ প্রমাণ হয়নি বা আপিলকারী ধর্ষণ করেনি এ অজুহাতে আসামি খালাস পেতে পারে না। এই রায়কে যুগান্তকারী বলে অভিহিত করেছেন আইনজীবীরা। সমাজে যারা নির্যাতিত, ধর্ষিত ও ভিকটিম তারা বিচারের জন্য আদালতে আসতে চান না। এই রায় অনেক বিচারপ্রার্থীকে অনুপ্রাণিত করবে, ভিকটিমরা আদালতে ন্যায়বিচার পাবেন।
পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা থাকলে তারা এ ধরনের জঘন্য অপরাধ করতে পারে না। সামাজিকভাবে ধর্ষকদের বয়কট করতে হবে। ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে আইনের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে সরকার যে অধ্যাদেশ জারি করেছে তা একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ। এ সাজা নিশ্চিত করা হলে অপরাধীদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হবে। ফলে অপরাধের মাত্রা কমে আসবে। তবে সবার আগে প্রয়োজন পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তন। নারীকে সম্মানের দৃষ্টিতে না দেখলে সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ নির্মূল করা কঠিন। এটা মূলত নৈতিকতার অভাবের কারণেই সংঘটিত হয়ে থাকে।
সরকার নারী নির্যাতন প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। পুলিশ প্রশাসনও অত্যন্ত তৎপর াাছে। অপরাধীদের দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তর করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এ ছাড়া অপরাধীরা কোনোভাবেই যেন প্রশ্রয় না পায়, সেদিকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। সরকারের নতুন এই আইন ধর্ষণ প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।
মি জা নু র র হ মা ন প লা শ
পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার