দ্রুত মারা যাচ্ছেন করোনায় আক্রান্তরা

ছবি: বাংলাদেশের খবর

জাতীয়

দ্রুত মারা যাচ্ছেন করোনায় আক্রান্তরা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৯ এপ্রিল, ২০২১

করোনা মহামারীর তীব্রতা আরো বেড়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্তরা আগের চেয়ে দ্রুত মারা যাচ্ছেন। করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির পাঁচ দিনের মধ্যে ৫২ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। এর মধ্যে ২৬ শতাংশ রোগী উপসর্গ শুরু পাঁচ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ভর্তি হয়েছিল। ১২ শতাংশ ভর্তি হয় উপসর্গ শুরু ১১ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে। মহামারীর প্রভাব পড়ছে মানসিক স্বাস্থ্যেও। গত শনিবার এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর।

বাংলাদেশে দ্বিতীয় ঢেউয়ে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে দুটি ধরনের উপস্থিতি বেশি ধরা পড়েছে। গত ১৮ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে গবেষকরা ৫৭টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করে ৪৬টিতে দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনের উপস্থিতি পেয়েছেন- যা মোট শনাক্তের ৮১ শতাংশ। গবেষণা কেন্দ্রটি জানিয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকার এই ধরন ৭০ শতাংশের বেশি সংক্রমণশীল। এ কারণেই এবার করোনা গত বছরের চেয়ে বেশি হারে ছড়িয়ে পড়ছে।

করোনার নতুন ধরন আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টে কেবল মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে তা-ই নয়, রোগীদের সুস্থ হতেও স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি সময় লাগছে। ভাইরাস থেকে মুক্তি পেলেও শরীরে স্বাভাবিক শক্তি ফিরে আসতে অনেক সময় নিচ্ছে। নতুন ধরনের করোনা মূলত ফুসফুসে দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে এবং রক্ত জমাট বাঁধছে। আইসিইউ সাপোর্ট দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে দ্রুত, যেটি গত বছর দেখা যায়নি। গত ১৫ দিনে এক হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে- যা এর আগে কখনো দেখেনি বিশেষজ্ঞরা। নতুন ধরনের করোনা আক্রান্তের ধরন পরিবর্তনের কারণে চিকিৎসা পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনতে হচ্ছে।

চিকিৎসকরা জানান, এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হওয়া বেশির ভাগ রোগীর কোনো ধরনের উপসর্গ দেখা যায় না। কিন্তু হঠাৎ করে অবস্থা খারাপ হতে থাকে। চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। সিটি স্ক্যানে ফল ভালো এলেও দ্রুত অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে।

রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক নাজমুল ইসলাম বলেন, করোনার প্রথম ঢেউ থেকে দ্বিতীয় ঢেউ অনেক ভয়াবহ। নতুন ধরনের করোনায় তরুণরাও আক্রান্ত হচ্ছে। তবে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, করোনা আক্রান্তের ১৪ দিন পর রোগী এমনিতেই ভালো হয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও নতুন ধরনের  ক্ষেত্রে এটা হচ্ছে না। রোগীর অনেক সময় লাগছে সুস্থ ও স্বাভাবিক হতে। অনেক ক্ষেত্রে মানসিক ও স্মৃতিশক্তির ওপর প্রভাব পড়ছে। মানসিকভাবে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। অনেকের প্রচণ্ড মাথাব্যথা হচ্ছে। নিউরোসাইক্রিয়াটিক সমস্যা, যেমন কারো কারো মধ্যে পাগলাটে আচরণের প্রবণতা কিংবা ব্রেন ইনফেকশনের মতো উপসর্গও দেখা যাচ্ছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগের অধ্যাপক ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) প্রধান মোজাফফর হোসেন বলেন, এক মাস আগেও আইসিইউতে রোগীর চাপ অনেক কম ছিল। গত ৯ মার্চ থেকে আমাদের হাসপাতালের সব আইসিইউ শয্যা পরিপূর্ণ। বর্তমানে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের অধিকাংশরই আইসিইউ লাগছে। আগে বাড়িতে চিকিৎসা নিয়েই অধিকাংশ রোগী ভালো হয়ে যেত। এখন আক্রান্ত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে আইসিইউ প্রয়োজন হচ্ছে। আগে ৬ থেকে ৭ দিন আইসিইউতে থাকলে রোগী সুস্থ হয়ে যেত। তাদের কেবিনে রাখা যেত, এখন এটা আর সম্ভব হচ্ছে না। নতুন ধরনের করোনা মানুষকে অনেক বেশি ভোগাচ্ছে।

করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা যাওয়া রোগীদের একটা বড় অংশের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে ফুসফুসের সংক্রমণ। এদের মধ্যে কারো কারো হূদরোগ, কিডনি বিকল, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ও ক্যানসারও ছিল। চিকিৎসকরা বলছেন, নতুন ধরনের করোনা ফুসফুসকে সংক্রমিত করছে বেশি। মুগদা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আহমেদুল কবীর বলেন, নতুন ধরনের করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যু ঘটছে ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে। হঠাৎ করেই আক্রান্তদের তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকের অন্য জটিল রোগও ছিল। করোনায় প্রধানত ফুসফুস সংক্রমিত হয়। তার পরই এই ভাইরাস হূদযন্ত্রকে এবং পর্যায়ক্রমে অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করে। আগে করোনা রোগীকে এক সপ্তাহের বেশি আইসিইউতে রাখতে হতো না। এখন রোগীদের বেশি বেশি অক্সিজেন দেওয়া লাগছে। রক্তের অণুচক্রিকার সঙ্গে হিমোগ্লোবিনও কমে যাচ্ছে, যদিও তাদের আগে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার মতো রোগ বা রেকর্ড ছিল না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগের অধ্যাপক ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) প্রধান মোজাফফর হোসেন বলেন, আগে করোনা আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই বাড়িতে চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে উঠেছে। তবে এখন সেটা হচ্ছে না। এখন ফুসফুস খুব দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং অক্সিজেন লেভেলও আগের তুলনায় দ্রুত কমে যাচ্ছে। আগে রিকভারি হতে সময় লাগত ৫-৬ দিন। কিন্তু রিকভারি হতে অনেক বেশি সময় লাগছে। আগের চেয়ে রোগীদের বেশি অক্সিজেন লাগছে। অবস্থার অবনতি হলে কয়েকটি ধাপে চিকিৎসা দেওয়ার পরে আরো অবনতি হলে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হতো। বর্তমানে খুবই কম সময় হাতে পাওয়া যাচ্ছে। ভাইরাসটির সংক্রমণের ধরনেরও পরিবর্তন হয়েছে।

আইইডিসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়, এবছরের মার্চে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৬৩৮ জন। এপ্রিলের ১৫ তারিখ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৯৪১ জনের। সে অনুযায়ী দুই সপ্তাহেই মৃত্যুর হার এক লাফে ৪৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ বেড়েছে। এ বছর এপ্রিলে আগের বছরের সর্বোচ্চ মৃত্যু হারের চেয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি মৃত্যু হয়েছে।

করোনাভাইরাস মহামারীতে সংক্রমণের আতঙ্ক, চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা, মৃত্যুভয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, বেকারত্বের কারণে মানসিক সমস্যা বেড়েছে বলেও জানিয়েছে আইইডিসিআর। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপের ফলাফল তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে ছয় দশমিক সাত শতাংশের মধ্যে বিষন্নতা এবং চার দশমিক সাত শতাংশ মানুষ ভুগেছেন দুশ্চিন্তায়। মহামারীর সময় বাংলাদেশে পরিচালিত কয়েকটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৪৬ শতাংশের মধ্যে বিষন্নতা, ৩৩ শতাংশের মধ্যে দুশ্চিন্তার লক্ষণ পাওয়া গেছে। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীরা চাপ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads