দ্বিতীয় ডোজ হতে পারে স্পুটনিক-সিনোফার্ম!

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

দ্বিতীয় ডোজ হতে পারে স্পুটনিক-সিনোফার্ম!

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ৩০ এপ্রিল, ২০২১

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ভারত করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা দেওয়া বন্ধ করে দিলেও বাংলাদেশের জন্য আপাতত ভয়ের কিছু নেই। শিগগিরই দেশে নতুন টিকা আসছে এবং ২য় ডোজ হিসেবে স্পুটনিক বা সিনোফার্মের টিকা দেওয়া যেতে পারে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিএসএমএমইউয়ের ২৪তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সভায় তিনি এসব বলেন।

অনেকেই সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকা প্রথম ডোজ নিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার কারণে অনেকে এ টিকার দ্বিতীয় ডোজ পাবেন না-এমন শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে আমরা একটা মিটিং করে একটা কমিটি করেছি। সেই কমিটি পর্যালোচনা করবে দ্বিতীয় ডোজটা স্পুটনিক থেকে দেওয়া যায় কি না। তবে হয়তো দেওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতামত প্রয়োজন। 

অ্যাস্ট্রাজেনেকার ব্যাপারে এত বেশি ভয়ের কারণ নেই। দুবাই অথবা কোরিয়া থেকে এটা আনার ব্যাপারে কথা চলছে। মে পর্যন্ত যেহেতু আমাদের ২য় ডোজ দেওয়া যাবে, সেহেতু হতাশার কোনো কারণ নেই। এরই মধ্যে আমরা রিপোর্ট পেয়ে যাব, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আসছে কি না অথবা স্পুটনিক বা সিনোফার্মের টিকা থেকে ২য় ডোজ দেওয়া যাবে কি না। এর ফল যদি ইতিবাচক হয় তাহলে এ নিয়ে কথা বলার আর কোনো অবকাশ নেই। কোনো কোনো আর্টিকেলে বলা আছে, এটা হয়তো দেওয়া যাবে।

এদিকে চীনা কোম্পানি সিনোফার্মের তৈরি টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিল সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান এ কথা জানান। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার সরবরাহ সংকটে টিকাদান কার্যক্রম নিয়ে জটিলতার মধ্যে দ্রুত দুটি নতুন টিকার অনুমোদন দেওয়া হলো। গত বুধবার মস্কোর গামালিয়া ইনস্টিটিউটের তৈরি স্পুটনিক-ভি টিকা বাংলাদেশের ঔষধ প্রশাসনের সবুজ সংকেত পায়।

সিনোফার্মের তৈরি টিকার আনুষ্ঠানিক নাম বিবিআইবিপি-কোরভি (ইইওইচ-ঈড়ৎঠ)। এ টিকাও ২৮ দিনের ব্যবধানে দুই ডোজ করে নিতে হয়। পরীক্ষামূলক প্রয়োগে এ টিকা ৭৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছে বলে উৎপাদনকারীদের ভাষ্য। এই টিকা কেনা হবে সরকারি পর্যায়ে। এ ছাড়া চীন অনুদান হিসেবে আমাদের ৫ লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে। এগুলো আগামী এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশে আসবে। এই টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়াল হয়েছে চীনে। তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল বিশ্বের পাঁচটি দেশের ৫৫ হাজার মানুষের ওপর হয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি কমিটি এ টিকার সব নথিপত্র যাচাই করেছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে আমাদের যে কমিটি আছে, তারা এই টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এর ভিত্তিতে আজ চীনের সিনোফার্মের এই টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছি।

তিনি বলেন, টিকা বাংলাদেশে আসার পর প্রথমে ১ হাজার মানুষের ওপর প্রয়োগ করে তাদের পর্যবেক্ষণ করা হবে। এই টিকার সেইফটি এবং অ্যাফিকেসি কেমন তা দেখা হবে। এরপর গণটিকাদান কার্যক্রমে সিনোফার্মের টিকা ব্যবহার করা হবে। কেবল আমদানি নয়, স্পুটনিক-ভি ও সিনোফার্মের টিকা দেশে উৎপাদনের জন্য ইতোমধ্যে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে অথবা কাঁচামাল নিয়ে এসে বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিতে টিকা উৎপাদন করা যাবে।

প্রসঙ্গত, চীনের বেজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রডাক্টসের উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-কোরভি নামের এই দুই ডোজের টিকা জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়া যাবে কি না আগামী সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে। চীন এরই মধ্যে এই টিকার কোটি ডোজের বেশি মজুত গড়ে তুলেছে এবং নিজ দেশে ব্যবহার করছে। পাশাপাশি এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার অনেক দেশে রপ্তানিও করছে। কোনো টিকার জরুরি ব্যবহারের জন্য ডব্লিউএইচওর অনুমোদন পাওয়া ওই টিকার নিরাপত্তা ও সক্রিয়তার একটি সূচক হিসেবে গণ্য হয়। বিভিন্ন দেশের জাতীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর জন্যও তখন ওই টিকার অনুমোদন দেওয়া সহজ হয়ে যায়।

ডব্লিউএইচওর অনুমোদন পেলে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য টিকার সরবরাহ নিশ্চিত করার জোট কোভ্যাক্সের তালিকাভুক্ত হবে সিনোফার্মের এই টিকা। সে ক্ষেত্রে চীনের এই টিকাই হবে পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে উদ্ভাবিত ও উৎপাদিত প্রথম বৈশ্বিকভাবে অনুমোদিত টিকা। ফাইজার-বায়োএনটেক, অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা জরুরি ব্যবহারে ডব্লিউএইচওর অনুমোদন পেয়েছে। এ সপ্তাহে মডার্নার টিকাও অনুমোদনের জন্য পর্যালোচনা করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সিনোফার্মের টিকার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে এর উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান বেইজিং বায়োলজিক্যাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তাদের টিকা মানবদেহে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ৭৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ কার্যকর বলে অন্তর্বর্তী তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দেখা গেছে। চীন, পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বেশ কয়েকটি দেশে এই টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষামূলক ব্যবহারের ফলের ভিত্তিতে সংযুক্ত আরব আমিরাত জানিয়েছে, এই টিকা ৮৬ শতাংশ কার্যকর। তবে তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষামূলক ব্যবহারের ফল হাতে পাওয়ার আগেই একটি জরুরি টিকাদান কর্মসূচির অধীনে চীনের প্রায় ১০ লাখ মানুষকে এই টিকা প্রয়োগ করা হয়।

ডিসেম্বরে পেরুতে এক স্বেচ্ছাসেবীর দেহে প্রয়োগের পর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জেরে এই টিকার পরীক্ষামূলক ব্যবহার স্থগিত করা হলেও পরে সেই স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া হয়। টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে এ ধরনের স্থগিতাদেশ অস্বাভাবিক নয়। ব্রিটনেও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার পরীক্ষামূলক ব্যবহার স্থগিত করা হয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে, যা পরে তুলে নেওয়া হয়।

ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা পরীক্ষামূলক প্রয়োগে অংশগ্রহণকারীদের রক্তের নমুনার ওপর পরীক্ষাগারের পরিচালিত গবেষণার ফলের সূত্র ধরে সিএনবিজির ভাইস প্রেসিডেন্ট ঝ্যাং ইউনতাও বলেন, সিনোফার্ম উৎপাদিত কোভিড-১৯ প্রতিরোধী দুটো টিকাই অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পেরেছে এবং ব্রিটেন ও সাউথ আফ্রিকার ধরন এবং আরো কয়েকটি ধরনকে বেশ ভালোভাবে কাবু করতে পেরেছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই টিকা গ্রহণকারীদের কয়েকজনের দেহে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি তৈরি না হওয়ায় তৃতীয় ডোজ প্রয়োগ করতে হয়। তবে এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। সিনোফার্ম জানিয়েছে, চীনের বাইরের দেশগুলোতে তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফল পর্যালোচনার পর তারা সিদ্ধান্ত নেবে যে দুই ডোজের এই টিকার জন্য আরেকটি ফলোআপ বুস্টার ডোজ দরকার হবে কি না।

১৩০ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে টিকা তৈরির পরীক্ষিত ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি অনুসরণ করে এই টিকার উদ্ভাবনে নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাস ব্যবহার করেছে সিনোফার্ম। ভাইরাসটি যাতে নিজের জিনের প্রতিরূপ তৈরি করতে না পারে সেজন্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান রাসায়নিক ব্যবহার করেছে।

উল্লেখ্য, করোনা মহামারী মোকাবিলায় সরকার দেশের ১৩ কোটির বেশি মানুষকে টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। সেই লক্ষ্যে গত নভেম্বরে সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটি ডোজ টিকা আনতে চুক্তি করে সরকার। প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে এই টিকা আসার কথা ছিল চুক্তিতে। তবে জানুয়ারিতে প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ, ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় চালানে ২০ লাখ ডোজ মিলিয়ে ৭০ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া ভারত সরকারের উপহার হিসেবে পাওয়া গেছে আরও ৩২ লাখ ডোজ টিকা।

ভারতে করোনাভাইরাস মহামারী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় দেশটি টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ফলে বাংলাদেশের কেনা বাকি ২ কোটি ৩০ লাখ ডোজ টিকা কবে আসবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। এমতাবস্থা সরকা দ্রুত টিকা আনতে বিকল্প উৎসের খোঁজ শুরু করে। এরই অংশ হিসাবে রাশিয়া ও চীন থেকে টিকা আনার অনুমোদন দেওয়া হয়। দেশে গত ৭ ফেব্রুয়ারি গণটিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। ৮ এপ্রিল শুরু হয় দ্বিতীয় ডোজ টিকাদান। ভারত থেকে টিকা আসা অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। কেনা টিকার বাইরে কোভ্যাক্সের আওতায় ফাইজারের এক লাখ ডোজ টিকা মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দেশে পৌঁছাবে বলে সরকার আশা করছে।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads