নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাত-্উল-মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবির দেড়শতাধিক জঙ্গিকে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদের মধ্যে কেউ কেউ কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে আর আদালতে হাজিরা দেয়নি। পলাতক জঙ্গিরা বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত হয়ে সদস্য সংগ্রহ ও ডাকাতি করে অর্থনৈতিক ভাবে সংগঠনকে শক্তিশালী করার পরিকল্পনা করছে।
ময়মনসিংহ ও রাজধানীতে গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিদের কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। আর এ তথ্য ধরেই দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিদের গ্রেপ্তারে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর আগেও রাজধানীর তেজগাঁও এবং আশুলিয়া এলাকায় ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ঘটনায় কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়। তবে সেই পরিকল্পনা থেকে এখনো সরেনি তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, শুধুমাত্র জেএমবির জঙ্গিরাই ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে জড়িত। প্রায় দেড়শর মতো সদস্য রয়েছে যারা আত্মগোপনে রয়েছে। এদের গ্রেপ্তারে কাজ করা হচ্ছে। জানা যায়, গত ৪ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহে জেএমবির ৪ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরা হলো-ময়মনসিংহের জুলহাস উদ্দিন, মো. আলাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোহাম্মদ রোবায়েদ আলম ও রংপুরের মো. আবু আইয়ুব। তাদের বর্তমানে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
র্যাব ১৪ এর অধিনায়ক মো. রোকনুজ্জামান বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা তাদের সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ডাকাতির জন্য দায়িত্ব পেয়েছিলেন। এজন্য জামালপুরের একটি গোপন আস্তানায় বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাদের।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছেন, এরই মধ্যে ময়মনসিংহের কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও, স্বর্ণালংকারের দোকান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে একটি টার্গেট ঠিক করেছিল। জল ও স্থলপথ হয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছার পরিকল্পনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে নৌকা, মাইক্রোবাস ও বাইক অন্তর্ভুক্ত ছিল। লুট করা অর্থ ময়মনসিংহের একটি এলাকার অপর একটি দলের নিকট হস্তান্তর করার পরিকল্পনা ছিল।
তারা আরো জানান, চলতি বছরের গত ৩১ আগস্ট জামালপুরের মাদারগঞ্জের একটি আস্তানায় তারা জড়ো হয়। পরবর্তীতে পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১ সেপ্টেম্বর বিকেলে জামালপুরের জামতলা চর এলাকা থেকে ব্রাহ্মপুত্র নদ দিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যাত্রা করে। গোপনীয়তা বজায় রাখতে তারা বিভিন্ন চরে যাত্রাবিরতি করে। এরপর মধ্যরাতে ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে ময়মনসিংহের খাগডহর এলাকায় পৌঁছায়। ডাকাতির নেতৃত্বে ছিল গ্রেপ্তার জঙ্গি জুলহাস। তার নেতৃত্বে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে দায়িত্ব পালনের পরিকল্পনা করেছিল। দলের সদস্যদের হাউস ও লক ব্রেকিংসহ বিভিন্ন দায়িত্ব দেয়া হয়।
মো. রোকনুজ্জামান বলেন, গ্রেপ্তার চারজনের প্রধান ছিলেন জুলহাস। তিনি ২০০৫ সালে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে আলিম পাস করেন। ২০০২ সালে জামালপুরের একটি মাদ্রাসায় দাখিল পড়ার সময় এক দর্জি মাস্টারের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। ওই দর্জির দোকানে তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতেন এবং সেখানে বিভিন্ন উগ্রবাদী ওয়াজ ও গজল শুনতেন। এরপর মুক্তাগাছায় একটি মাদ্রাসায় আলিম পড়ার সময় তিনি জেএমবিতে যুক্ত হন। সে সময় মুক্তাগাছার একজন আঞ্চলিক নেতার অধীনে তিনি বায়াত গ্রহণ করেন। বায়াত গ্রহণে ১০ জন জেএমবি সদস্য অংশ নেন। এই ১০ জনের কয়েকজনকে বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তারও করেছে। কয়েকজন এখনো আত্মগোপনে আছেন।
তিনি আরো বলেন, বাংলাভাই ও শীর্ষ জঙ্গি নেতা সালাউদ্দিন সালেহীনের সঙ্গে জুলহাসের পরিচয় হয়েছিল। সালেহীন বিভিন্ন সময়ে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে অবস্থানকালে জঙ্গি জুলহাস তাদেরকে বিভিন্ন সহায়তা করতেন। তিনি ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জঙ্গিসংশ্লিষ্টতায় ২ বছর কারাগারে ছিলেন। বাংলা ভাইয়ের একজন ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন জুলহাস।
এরপর তিনি নিজ এলাকায় জঙ্গিবাদ প্রচারের জন্য একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও সেখানে শিক্ষকতা শুরু করেন। ওই মাদ্রাসার দুইজন শিক্ষক জঙ্গিবাদে সংশ্লিষ্টতা থাকায় গ্রেপ্তার হন। তখন তিনি সম্ভাব্য গ্রেপ্তার এড়াতে ২০১২ সালে আত্মগোপনে চলে যান। ফলে মাদ্রাসাটি বন্ধ হয়ে যায়। জুলহাস টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় ছদ্মনামে বিভিন্ন মাদ্রাসা, মসজিদে ইমামতি ও শিক্ষকতা পেশায় থেকে জঙ্গি কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন।
এদিকে গত ৮ সেপ্টেম্বর রাতে বসিলায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। আর এ আস্তানা থেকেই আটক করা হয় দীর্ঘদিন ধরে খোঁজ করা জঙ্গি এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টার।
জানা যায়, ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তার জেএমবির চার সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই জঙ্গির আস্তানা সন্ধান পাওয়া যায়। গ্রেপ্তার জঙ্গিরা জিজ্ঞাসাবাদে বসিলা থেকে আটক জঙ্গির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দিয়েছিল র্যাবকে। এর ভিত্তিতে র্যাব ঢাকার বাইরে জামালপুর ও রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করে। পরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মধ্যরাত থেকে বসিলার জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায়। অভিযানে বর্তমান সময়ের জেএমবির এই শীর্ষ নেতাকে আটক করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে উজ্জ্বল মাস্টারকেও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তার জেএমবির চার সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই জঙ্গির আস্তানা সন্ধান পাওয়া যায়। গ্রেপ্তার জঙ্গিরা জিজ্ঞাসাবাদে বসিলা থেকে আটক জঙ্গির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দিয়েছিল র্যাবকে। এর ভিত্তিতে র্যাব ঢাকার বাইরে জামালপুর ও রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করে। পরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মধ্যরাত থেকে বসিলার জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায়। অভিযানে বর্তমান সময়ের জেএমবির এই শীর্ষ নেতাকে আটক করতে সক্ষম হয়।
তিনি বলেন, জেএমবি সদস্যরা বর্তমানে ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পুরাতন সদস্যদের সংগ্রহ করছে এবং সংগঠনকে চাঙা করছে। ‘জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানতে পেরেছেন জেএমবির সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংগঠনের অর্থের প্রয়োজনে এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টার ডাকাতির পরিকল্পনা করছিল এবং কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল।’ তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে পলাতক জঙ্গিদের বিষয়ে আমরা তথ্য পেয়েছি। এগুলোকে ধরতে আমরা মাঠে কাজ করছি।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, পলাতক প্রায় দেড়শ জেএমবির সদস্য দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে রয়েছে। এরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সংগঠনকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে। তারা বর্তমানে অর্থসঙ্কটে রয়েছে। আর এ সঙ্কট কাটাতেই ডাকাতির পরিকল্পনা করে যাচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, এর আগে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় এক ডাকাতির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে জেএমবির সংশ্লিষ্টতা পায় ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম। তারও আগে আশুলিয়া এলাকাতে ব্যাংক ডাকাতির সঙ্গে জেএমবির সংশ্লিষ্টতা ছিল।