ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ সুস্বাদু ফল মাল্টার উৎপাদন দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক সম্ভাবনাময়। তবে পার্বত্য ও বরেন্দ্র অঞ্চলসহ সমতলেও মাল্টার বাণিজ্যিক চাষে সফলতা এসেছে। এ ছাড়া ঢাকা ও বিভাগীয় শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় ছাদবাগানে শৌখিনভাবে অনেকে মাল্টার চাষ করে ভালো ফল পাচ্ছেন। এভাবে সারা দেশে মাল্টার চাষ ছড়িয়ে পড়েছে গত এক দশকে। ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকরাও ঝুঁকছেন মাল্টা চাষে। পাহাড়ে, সমতলে সমানতালে মাল্টা চাষের চেষ্টা নতুনভাবে আশা জাগাচ্ছে। দেশে মাল্টা চাষের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন নাহিদ বিন রফিক এবং এস এম মুকুল
সাইট্রাস পরিবারভুক্ত একটি বিদেশি ফল মাল্টা। ইংরেজি নাম সুইট অরেঞ্জ। কমলা আর বাতাবি লেবুর সংকরায়ণে এ ফলের সৃষ্টি। মাল্টার আদি উৎপত্তিস্থল ভিয়েতনাম, দক্ষিণ চীন এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত। টক-মিষ্টি মাল্টা খেতে সুস্বাদু। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, কমলালেবুর তুলনায় এর অভিযোজন ক্ষমতা বেশি। তাই মাল্টা চাষের জন্য উৎকৃষ্ট পাহাড়ি এলাকা। তবে হালকা লবণমাটিতে এর মিষ্টতা এবং ফলন ভালো। অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে মাল্টা হার্বেস্টের উপযুক্ত সময়।
মাল্টার জেলা পিরোজপুর
মাটি, পানি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় দক্ষিণাঞ্চল মাল্টা চাষের বিরাট সম্ভাবনাময় এলাকা। ফলনের ব্যাপকতা ও বাগান বৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যে পিরোজপুর মাল্টার জেলা হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছে। মাল্টা এখন পিরোজপুরের জেলা ব্র্যান্ডিং। কয়েকজন পথিকৃৎ ফলচাষি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সহায়তায় মাল্টাকে এ জেলার সম্ভাবনাময় একটি ফল হিসেবে পরিচিত করেছেন। আগে নারকেল, সুপারি, কলা, আমড়া ইত্যাদির ব্যাপক আবাদ করে এ এলাকার কৃষকরা সন্তুষ্ট থাকতেন। তবে মাল্টা চাষের সাফল্য এ এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে বাগান বৃদ্ধির পেছনে ভূমিকা রাখছে। মাল্টার চাষ কৃষকদের মাঝে নতুন আশাবাদ জাগিয়েছে। ফলে দেখা গেছে, এখন শখের বশে বছরে দু-একটি মাল্টার বাগান হচ্ছে। এভাবে এলাকায় কমবেশি ৭০০ বাগান রয়েছে বলে জানা গেছে।
নতুন জাত উদ্ভাবন
২০০৬ সালে খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের কৃষিবিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেন মিষ্টি কমলার উন্নত জাতের বারি মাল্টা-১। মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় এ ফলটি এই অঞ্চলে খুবই সম্ভাবনাময়। এ ছাড়া মাল্টার দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাত রয়েছে। তবে এদেশে চাষ উপযোগী জাতের মধ্যে বারি মাল্টা-১ অন্যতম। মধ্যফাল্গুন (মার্চ) থেকে মধ্যচৈত্রে (এপ্রিল) ফুল আসে। ফল পাকে কার্তিক মাসে। ফল দেখতে সবুজ। তবে পরিপক্ব অবস্থায় কিছুদিন রেখে দিলে কমলারঙ ধারণ করে। ফলের নিচে ছোট গোলাকার চিহ্ন থাকে। প্রতিটির ওজন প্রায় ১৫০ গ্রাম। ফলের শাঁসের রঙ হালকা হলুদ। গাছপ্রতি ফল ধরে ৩০০ থেকে ৪০০। সে হিসাবে হেক্টরপ্রতি গড় ফলন প্রায় ২০ টন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একটি জাত উদ্ভাবন করেছে। নাম এফটিআইপি বাউ মাল্টা-১। প্রতিটি ফলের ওজন ১৭০ থেকে ২০০ গ্রাম। মিষ্টতা ১৭-২১ টিএসএস। গাছ বামনাকৃতির। বিচি কম হয়। ফল রসালো ও মিষ্টি। মার্চ-এপ্রিল মাসে ফুল আসে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ফল পাকে।
বংশবিস্তার
বীজ ও অঙ্গজ উভয় পদ্ধতিতে মাল্টার বংশবিস্তার হয়। তবে মাতৃগুণ বজায় রাখা, দ্রুত ফল ধরা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো এবং অধিক ফলন পেতে অঙ্গজ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। জোড়কলম (গ্রাফটিং) ও চোখকলমের (বাডিং) মাধ্যমে চারা উৎপাদন করা যায়। জোড়কলমের জন্য রুটস্টক (আদিজোড়) নির্বাচন করতে হয়। এক্ষেত্রে বাতাবি লেবুর চারা ব্যবহার উত্তম। মধ্যবৈশাখ থেকে মধ্যভাদ্র (মে-আগস্ট) গ্রাফটিং করার উপযুক্ত সময়। চারা অবশ্যই মানসম্মত হওয়া চাই। সরকারি প্রতিষ্ঠান হর্টিকালচার সেন্টার এবং বেসরকারি বিশ্বস্ত নার্সারি থেকে সংগ্রহ করা উত্তম। এ ছাড়া কিছু সফল কৃষক আছেন, যারা বাগানের পাশাপাশি চারাও উৎপাদন করেন।
ব্যাগিং ফলের জন্য আশীর্বাদ
ব্যাগিং করলে ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ হয় না। চীনে উৎপাদিত একধরনের উন্নত ব্যাগ যা এখন আমাদের দেশেও পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিটির দাম আড়াই থেকে তিন টাকা। পাতার ঘর্ষণ ও তীব্র সূর্যকিরণ থেকে এই ব্যাগ ফলকে রক্ষা করে। বিভিন্ন পাখি এবং বাঁদুরের উপদ্রব হয় না। এ ব্যাগ দু-তিন বছর ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া দেশীয় পদ্ধতিতে পলিথিন, কাপড় কিংবা বাটার পেপার দিয়ে ব্যাগিং করা যেতে পারে।
পার্বত্য অঞ্চল
চট্টগ্রামের অনুকূলে জলবায়ু ও আবহাওয়ায় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মাল্টাচাষ। মাল্টার বাণিজ্যিক চাষে ভাগ্যও বদলে গেছে পাহাড়ের অনেক বেকার যুবকের। রোগবালাই ও ঝরেপড়া কম এবং উৎপাদন ভালো হওয়ায় কৃষকদের কাছেও বাণিজ্যিক চাহিদা বেড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। খাগড়াছড়ির সব উপজেলায় মাল্টার চাষাবাদ করেছেন বহু কৃষক। ঘরের আঙিনায়ও চাষ হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে মাল্টার বাগান করে লাভের মুখ দেখেছেন অনেকে। এখানকার মাটি ও জলবায়ু দুটিই মাল্টা চাষের উপযোগী। দিন দিন এ জেলায় এ ফলের চাষ বাড়ছে। চাষ হওয়া বারি মাল্টা-১ অত্যন্ত সুস্বাদু। খাগড়াছড়ির সব উপজেলায় সাধারণ কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে মাল্টার বাগান করে লাভবান হয়েছেন।
বিভিন্ন সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, খাগড়াছড়িতে কমবেশি ৩০০ হেক্টর জমিতে মাল্টার বাণিজ্যিক বাগান গড়ে উঠেছে। কৃষি বিভাগের সাইট্রাস প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ২০০ জনকে বাগান আর ৭৫০ জনের মধ্যে মাল্টার চারা বিতরণ করা হয়। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করেও বারি মাল্টা-১ দেশের সর্বত্র পাঠানোর সম্ভাবনা ব্যাপক।
বরেন্দ্র অঞ্চল
বরেন্দ্র ভূমি হিসেবে পরিচিত নওগাঁর সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর, মহাদেবপুর, পত্নীতলা ও ধামইরহাট উপজেলায় মাল্টা চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন কৃষক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহযোগিতা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে গত দুই বছরে প্রায় শতাধিক বিঘা জমিতে মাল্টার বাগান গড়ে উঠেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, পোরশা, সাপাহার, নিয়ামতপুর, মহাদেবপুর, বদলগাছী, ধামইরহাট উপজেলার অধিকাংশ জমিতে আমন ধান ছাড়া অন্য কোনো ফসল উৎপাদন হয় না। ইতোমধ্যে জেলায় শতাধিক বিঘা জমিতে মাল্টা চাষ করা হয়েছে। অনেক কৃষক কৃষি বিভাগ থেকে চারা নিয়ে জমিতে মাল্টা চাষ করেছেন। আম চাষের পাশাপাশি মাল্টা চাষ বেশ লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা মাল্টা চাষের দিকে ঝুঁকবেন।
বগুড়া
বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে দেশি মাল্টা চাষ করছেন জাহাঙ্গীর আলম মিঠু নামে এক যুবক। রসালো মিষ্টি ও সুস্বাদু দেশি জাতের মাল্টা চাষ করে তিনি সুদিনের স্বপ্ন দেখছেন। মিঠুর বাড়ি জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার নারচী ইউনিয়নের কুপতলা গ্রামে। ২০১৭ সালের জুন মাসে তিনি কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের কৃষি অনুষ্ঠানে মাল্টা চাষ দেখে মাল্টা চাষে উদ্বুদ্ধ হন। পিরোজপুর জেলার মাল্টা চাষ দেখে সেখানে যান কলম চারা সংগ্রহের জন্য। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) উদ্ভাবিত বারি-১ জাতের প্রতিটি কলম চারাগাছ ৩৫০ টাকা দরে কিনে নিজের তিন বিঘা ও বার্ষিক পত্তন নিয়ে আরো তিন বিঘাসহ মোট ছয় বিঘা জমিতে চারাগাছ রোপণ করেন। এরপর তার পরিচর্যা করছেন।
ঠাকুরগাঁও
ঠাকুরগাঁওয়ের মাল্টা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, হরিপুর, পীরগঞ্জ, রানীশংকৈল, বালিয়াডাঙ্গী ও সদর উপজেলার প্রায় ৬০ হেক্টর জমিতে এবং প্রায় ৩ হেক্টর জমির বসতবাড়িতে মাল্টা, কমলা, বাদাম ও কলম্ব চাষ হয়েছে। এর বেশিরভাগই মাল্টা ও কমলা। কয়েক বছর ধরে এ জেলায় চাষ হচ্ছে মাল্টা। মাল্টা চাষ করে কৃষকরা অল্প সময়ে লাভবান হওয়ায় তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আরো যেসব এলাকায় মাল্টা চাষে কৃষকরা সফল হয়েছেন- দিনাজপুরের বিরামপুরে বারি-১ গ্রিন জাতের মাল্টার আবাদ করে সফলতা পেয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। রাঙামাটিতে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে দেশীয় মাল্টার চাষ। লটকন আর লেবু চাষে সফলতার পর নরসিংদীর শিবপুরের কৃষকরা ঝুঁকছেন মাল্টা চাষে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মাল্টার চাষ। ময়মনসিংহের ভালুকায় গ্রিন মাল্টার বাম্পার ফলন হয়েছে। ফটিকছড়িসহ দেশের আরো নানান প্রান্তে মাল্টা চাষ ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে।
লেখক : টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস, বরিশাল এবং কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক