লক্ষ্মণ চন্দ্র মন্ডল
আমাদের কৃষি ক্ষেত্রে যে সফলতা এর মূলে যে কজন হাতে-গোনা কৃষিবিজ্ঞানীর নাম শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করতে হয় তাদের মধ্যে পুরোধা ব্যক্তি হচ্ছেন ড. এম কাজী বদরুদ্দোজা। তিনি বাংলাদেশের কৃষির এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারার মতো দেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে অদ্যাবধি কাজ করে চলেছেন। তিনি বাংলাদেশের কৃষি গবেষণার গোড়াপত্তনকারী হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। তার নানামুখী কর্মকাণ্ডের মধ্যে বাংলাদেশে সমন্বিত কৃষি গবেষণার সিস্টেম (এনএআরএস) প্রবর্তন, বহু গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা, কৃষি গবেষণায় দক্ষ জনবল সংগ্রহ ও তৈরি করা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মোটকথা যুদ্ধবিধ্বস্ত খাদ্যসংকটে নিমজ্জিত সদ্য স্বাধীন কৃষি প্রধান বাংলাদেশের উপযোগী কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ।
ড. কাজী বদরুদ্দোজার পূর্বপুরুষ এসেছিলেন মিরাটের নবাব বংশ থেকে। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাংলার মাটিতে। এ দেশের মাটি ও মানুষ আপন করে নিয়েছিল তাকে। তিনিও মিশে গিয়েছিলেন এ দেশের মাটি ও মানুষের সাথে। তার উত্তরসূরিরা গাইবান্ধার সবুজ শ্যামলিমায় বেড়ে ওঠা বাঙালি। সেই পরিবারে ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি ড. কাজী বদরুদ্দোজার জন্ম। ১৯৪২ সালে তিনি গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ হাইস্কুল থেকে বিরল কৃতিত্ব, ইংরেজি ভাষায় ‘লেটার’ সহকারে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে তিনি আইএসসি, উপমহাদেশের প্রথম কৃষি কলেজ তেজগাঁওস্থ বেঙ্গল এগ্রিকালচার ইনিস্টিটিউট থেকে ১৯৪৮ সালে বিএজি ও ১৯৫২ সালে এমজি ডিগ্রি লাভ করেন। অধুনালুপ্ত ঢাকা ফার্মসংলগ্ন এগ্রিকালচার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে ড. এম কাজী বদরুদ্দোজার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। চমকপ্রদ ব্যক্তিত্বের মাঝে পেশাগত পাণ্ডিত্য ও নেতৃত্বের সুসমন্বয় লক্ষ্য করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাকে মার্কিন দেশে উচ্চতর শিক্ষার জন্য প্রেরণ করে। ১৯৫৬ সালে লুইজিয়ানা ইউনির্ভাসিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং কৃষি গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৫৭ সালে ড. এম কাজী বদরুদ্দোজা ইকোনমিক বোটানিস্ট (ফাইবার) পদ অলংকৃত করেন। সেদিনের কৃষকের কাছে স্বল্প পরিচিত ফসল গম ও ভুট্টা গবেষণা তার নেতৃত্বে বেগবান হয়ে ওঠে। উদ্ভিদ প্রজননে সুদক্ষ কলাকৌশল আয়ত্ত করার জন্য তিনি সুইডেনের বিশ্বখ্যাত স্তালভ গবেষণা কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ লাভ করেন এবং ল্যান্ড ইউনিভার্ির্সটি থেকে ডিপ-ইন জিনেটিক্স উপাধি অর্জন করে ১৯৬১ সালে দেশে ফিরে নতুন উদ্যমে কৃষি গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। বাংলাদেশে ব্যাপক গম উৎপাদনের সম্ভাবনা তার বিজ্ঞানী দূরদৃষ্টিতে স্থায়ী আসন করে নেয়। পরবর্তীকালে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত পাকিস্তান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ কাউন্সিলের পরিচালক, নির্বাহী পরিচালক ও মহাপরিচালকের দায়িত্বে আসীন হয়ে তিনিই প্রথম বাংলাদেশে উচ্চফলনশীল গম প্রর্বতন করার উদ্যোগ নেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তার বলিষ্ঠ উদ্যোগ ও পূর্ব পাকিস্তানে সে সময়ের ইকোনমিক বোটানিস্ট (ফাইবার) ড. হাসানুজ্জামানের নেতৃত্বে উচ্চফলনশীল গম গবেষণা বাংলার কৃষিতে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দেয়। এর ফল হিসেবে এ দেশের কৃষক আজ উচ্চফলনশীল গম আবাদ করে খাদ্য ঘাটতি কমাতে সক্ষম হয়েছে।
১৯৭১ সালে যুদ্ধবিধ্ববস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে আরো বিধ্বস্ত এ দেশের কৃষি গবেষণাকে নতুন করে দাঁড় করানোর দায়িত্ব নেন ড. এম কাজী বদরুদ্দোজা। তার সুদক্ষ নেতৃত্বে গড়ে ওঠে জয়দেবপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মতো বিশাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তিনিই ‘বারি’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ সালে অবসর গ্রহণের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ড. এম কাজী বদরুদ্দোজা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদ অলংকৃত করেন এবং তার উদ্যোগের ফলেই প্রতিষ্ঠিত হয় সাভারে বাংলাদেশ পশুসম্পদ গবেষণা ও ময়মনসিংহের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ সালনার ইনস্টিটিউট ফর পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ ইন এগ্রিকালচার (ইপসা)। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসূত্রে গেঁথে এ দেশের কৃষি ও কৃষকের প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামগ্রিক কৃষি গবেষণাকে সুসমন্বিত করার উদ্দেশ্যে ড. এম কাজী বদরুদ্দোজার অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শুধু কৃষিতেই ড. এম কাজী বদরুদ্দোজার কর্মবিস্তৃতি সীমাবদ্ধ থাকেনি; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বা সিনেটে এবং বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের উপদেষ্টা বোর্ডে তিনি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সাউথ এশিয়ান অ্যাসোশিয়েশন ফর রিজিয়নাল কো-অপারেশন (সার্ক) গঠনের সময় এগ্রিকালচার গ্রুপের সভাপতি হিসেবে ড. বদরুদ্দোজার সুদক্ষ নেতৃত্ব বাংলাদেশের জন্য এনেছে বিরল কৃতিত্ব। ফিলিপাইনের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) মূল্যায়ন বোর্ডের সদস্য হিসেবে লন্ডনের ট্রপিকাল প্রোডাক্টস ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা কমিটিতে, নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অবস্থিত ইন্টারন্যশনাল সার্ির্ভস অব ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চের (ইজনার) বোর্ড অব ট্রাস্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ড. বদরুদ্দোজার অবদান দেশের জন্য এনেছে দুর্লভ খ্যাতি। প্রচারবিমুখ নিবেদিতচিত্ত এ বিজ্ঞানীর এ দেশের মানুষের জন্য আরো দুটি উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে অতি সুস্বাদু আম্রপলি আমের আর সুদর্শনীয় ও সুস্বাদু কাজী পেয়ারা জাত থাইল্যান্ড থেকে এনে এ দেশে প্রবর্তন করা। ‘কাজী’ পেয়ারা তার নামানুসারেই করা হয়েছে।
এ দেশের কৃষি উন্নয়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এই কৃষিবিজ্ঞানী পাকিস্তানি শাসনামলে তৎকালীন ঢাকাস্থ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে তার কর্মজীবন শুরু করলেও বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫৭ সালে ড. বদরুদ্দোজা ইকোনমিক বোটানিস্ট (ফাইবার) পদ অলংকৃত করেন। তার দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন ফসলের, বিশেষ করে গমের অনেক উন্নত জাত এ দেশের কৃষকদের হাত তুলে দিয়েছেন যা দেশের দানাদার খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি তথা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এছাড়া সার্ক গঠনের সময় এগ্রিকালচার গ্রুপের সভাপতি হিসেবে তার রয়েছে সুদক্ষ নেতৃত্ব। এই স্বনামধন্য বিজ্ঞানী দেশের বাইরেও আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস অব ন্যাশনাল এগ্রিকালচার রিসার্চসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে পালন করেন। এই ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানী তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের কৃষিতে তার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক পুরস্কার, খেতাব ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৮৫ সালে সরকার জাতীয় পর্যায়ে তাকে আজীবন ইমেরিটাস বিজ্ঞানী সম্মানে ভূষিত করে।
যশোরের বাঘারপাড়ার ‘গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্র’ ২০১২ সালের ৯, ১০ ও ১১ মার্চ তিন দিনব্যাপী খাজুরা এমএন মিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গ্রামীণ জীবনযাত্রা ও কৃষি প্রযুক্তি তথ্য, বীজ মেলার অনুষ্ঠান হয়। এই অনুষ্ঠানে দেশ তথা অত্র অঞ্চলের ৩০ জন গুণিজনকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। ওই সময় জীবদ্দশায় গুণিজন সম্মাননার মধ্যে জাতীয় বরেণ্য কৃষিবিজ্ঞানী ড. এম কাজী বদরুদ্দোজা ছিলেন অন্যতম একজন।
লেখক : সাংবাদিক