দেশের আকাশ থেকে খসে পড়ল আরেক নক্ষত্র

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

নাট্যাভিনেত্রী লিলি চৌধুরীর প্রয়াণ

দেশের আকাশ থেকে খসে পড়ল আরেক নক্ষত্র

  • প্রকাশিত ৩ মার্চ, ২০২১

আমাদের দেশে নাগরিক সমাজের পরিসর অত্যন্ত ছোট। এর মধ্যে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের প্রথিতযশা গবেষক, সাংবাদিক, কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং বাংলাদেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মৃত্যু নাগরিক সমাজকে আরো সংকুচিত করেছে। এ দুজনের মৃত্যু দেশ ও দেশের জনগণের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। এদের মৃত্যুশোক কাটিয়ে ওঠার আগেই দেশের আগামী প্রজন্মের আরেক পথিকৃৎ মৃত্যুবরণ করলেন। অগ্নিঝরা মার্চের প্রথম দিনে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী ও আন্তর্জাতিক সংবাদ টেলিভিশন রিয়েল নিউজ নেটওয়ার্কের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত আশফাক মুনীর চৌধুরী ওরফে মিশুক মুনীরের মা বাঙালি নারী জাগরণের পথিকৃৎ, একসময়ের বেতার, মঞ্চ ও টেলিভিশনের ব্যস্ততম এবং সুনামধন্য অভিনেত্রী লিলি চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি ৯৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করলেও বেঁচে থাকবেন এদেশের লাখো-কোটি মানুষের হূদয়ে, ভালোবাসার পরশে, অনন্তকালের দেশপ্রেমিকদের উজ্জ্বল সারিতে।

সাতচল্লিশ, বায়ান্ন, একাত্তরের মতো ঐতিহাসিক সময়ের সাক্ষী লিলি চৌধুরীর জন্ম ১৯২৮ সালের ৩১ আগস্ট টাঙ্গাইল জেলার জাঙ্গালিয়া গ্রামে অবস্থিত নানাবাড়িতে। তার পারিবারিক নাম ছিল লিলি মির্জা। অত্যন্ত সাদাসিধে মননের লিলি চৌধুরীর পুরোটা জীবন নিয়ে খুব বেশি উচ্ছ্বাস ছিল না। তার পুরো জীবনটা কেটেছে সুখ আর দুঃখের মিশেলে। জীবনের অধিকাংশ সময় সুখের চেয়ে দুঃখকে সাথী করে পথ চলেছেন তিনি।

লিলি চৌধুরীর বাবা নূর মোহাম্মদ মির্জা সরকারি চাকরি করতেন। আর মা আশরাফুন্নেসা ছিলেন গৃহিণী। সরকারি চাকরির কারণে বাবাকে ভারতবর্ষের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে বদলি হতে হতো। লিলি মির্জা বাল্যকাল থেকেই ছিলেন অনেকটা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। যখন তিনি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী সে সময়েই শুরু হয় তার হোস্টেল জীবন। তৃতীয় শ্রেণিতে তিনি ভর্তি হন বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত কলকাতা সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে। তিনি যখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী তখন প্রথম অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি নাটকে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শুরু হলে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলটি সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে লিলি মির্জা দিল্লিতে তার মা-বাবার কাছে চলে যান। সেখানে তিনি ইন্দ্রপ্রস্থ গার্লস হাইস্কুলে ভর্তি হন। ওই স্কুলে দুই শতাধিক ছাত্রীর মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র মুসলিম ছাত্রী। সে স্কুলেও তিনি নাট্যাঙ্গনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। একবার দুর্গাপূজায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নাটকে তিনি ‘ভারতমাতা’ চরিত্রে অভিনয় করেন। দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ গার্লস হাইস্কুলে দুই বছর শিক্ষালাভের পর পুনরায় লিলি মির্জা কলকাতায় থিতু হন। সেখানে ভর্তি হন সেই পুরনো প্রতিষ্ঠান সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে। এ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করার পর ভর্তি হন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। সেখানে তিনি দুই বছর লেখাপড়ার পাশাপাশি কলেজের সাংস্কৃতিক উৎসব ও হোস্টেলের নাটকগুলোতে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। এর মধ্যেই সাতচল্লিশের দেশভাগ। সৃষ্টি হলো ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি আলাদা রাষ্ট্রের। ১৯৪৮ সালের জুন মাসের শেষদিকে লিলি মির্জার বাবা নূর মোহাম্মদ মির্জা চাকরি নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। তৎকালীন বামপন্থি রাজনৈতিক আদর্শে উজ্জীবিত মুনীর চৌধুরীর ছোট বোন নাদেরা বেগম ও লিলি মির্জার বড় বোন নূরজাহান মির্জা ছিলেন সহপাঠী। সেই সুবাধে মুনীর চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ হয় লিলি মির্জার। একসময় তাদের উভয়ের মধ্যে ভালো লাগা জন্ম নেয়। লিলি মির্জা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। প্রায় প্রতিদিনই মুনীর চৌধুরী-লিলি মির্জা দেখা করতেন। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার করে মুনীর চৌধুরীকে। এ কারণে মুনীর কারাগারে আর লিলি মির্জার হূদয়ে উত্তাল ঢেউ। মুনীর চৌধুরী কারাগারে এবং লিলি মির্জা বাড়িতে বসে উভয়ে উভয়ের উদ্দেশে ডায়রি লেখা শুরু করেন। ২০১৫ সালে দুজনের এই ডায়েরিগুলো গ্রন্থ আকারে ‘দিনপঞ্জি-মনপঞ্জি-ডাকঘর’ প্রকাশ করে প্রথমা প্রকাশন। ১৯৪৯ সালের আগস্ট মাসে কারাগার থেকে মুক্ত হন মুনীর চৌধুরী। এর এক বছর পর ১৯৪৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তারা বসেন বিয়ের পিঁড়িতে। লিলি মির্জা হয়ে ওঠেন লিলি চৌধুরী। এরই মধ্যে মুনীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। আর লিলি চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ, গ্রন্থাগার বিজ্ঞান ও ফরাসি ভাষায় ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে বেতার, মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকে নিয়মিত অভিনয় চালিয়ে যান। সে সময়ে অভিনেত্রী ছিলেন হাতেগোনা। অনেক নাটকে ছেলেরাই মেয়ে চরিত্রে অভিনয় করতেন। যে কয়জন অভিনেত্রী তখন নিয়মিত অভিনয় করতেন, তাদের চেয়ে ভরাট কণ্ঠ, স্পষ্ট সংলাপ, আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি ইত্যাদির কারণে লিলি চৌধুরীর আলাদা কদর ছিল নির্মাতা মহলে। সে সময় তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে অনেক মেয়ে অভিনয়ে এগিয়ে আসেন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনের চারদিন পর ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার পুনরায় গ্রেপ্তার করে মুনীর চৌধুরীকে। এর পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তিন মাসের শিশুকে নিয়ে লিলি চৌধুরীকে বাসা ছাড়ার নির্দেশ দেয়। প্রায় দুই বছরের অধিককাল মুনীর চৌধুরী কারাবাস করার পর ১৯৫৪ সালে মুক্তি পান। এ সময় মুনীর চৌধুরী কারাগারে বসে রচনা করেন তার কালজয়ী ‘কবর’ নাটকটি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনেকেই মুনীর চৌধুরী ও লিলি চৌধুরীকে ভারতে চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু দেশপ্রেমিক মুনীর চৌধুরী ও লিলি চৌধুরী সন্তানদের নিয়ে দেশে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী নিজ বাসা থেকে মুনীর চৌধুরীকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর আর মুনীর চৌধুরী ফিরে আসেননি। দেশ স্বাধীনের পর লিলি চৌধুরী সংসার নিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। বিভিন্ন স্থানে চাকরি এবং অভিনয় অব্যাহত রেখে সন্তানদের গড়ে তুলেছেন দেশপ্রেমিক ও উচ্চ শিক্ষিত করে। আশির দশকের প্রথম দিকে চোখে জটিল অপারেশন হয় লিলি চৌধুরীর। এ সময় তিনি অভিনয় ছেড়ে দেন। এর আগেই তিনি তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ লাভ করেন নাট্যকার-নাট্যশিল্পী সংসদ, টেলিভিশন নাট্যশিল্পী, নাট্যকার সংসদ ও বাংলাদেশ মানবাধিকার নাট্য পরিষদ সম্মাননা স্মারক। নাটক ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি স্বামী মুনীর চৌধুরীর শুরু করা ‘টেনেসি উইলিয়ামসের স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’ নাটকের অসমাপ্ত অনুবাদের কাজ শেষ করেন। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট তার পুত্র সাংবাদিক আশফাক মুনীর চৌধুরী ওরফে মিশুক মুনীর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। এ মৃত্যুতে লিলি চৌধুরী মানসিকভাবে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে তার শরীরের অবনতি ঘটে। এর মধ্যে ভর করে বার্ধক্য। গত কয়েক বছর যাবত বাঙালি নারী জাগরণের পথিকৃৎ, একসময়ের বেতার, মঞ্চ ও টেলিভিশনের ব্যস্ততম এবং সুনামধন্য অভিনেত্রী লিলি চৌধুরী বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে রাজধানী ঢাকার বনানীস্থ নিজ বাসভবনে অবস্থান করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ১ মার্চ বিকেল সাড়ে ৫টায় ৯৩ বছর বয়সে নিজ বাসভবনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ইসমাইল মাহমুদ

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads