মো. আশিকুর রহমান
বিশ্বায়নের এই তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ যুগে টিকে থাকার প্রথম ও প্রধান উপাদান হলো দক্ষ জনশক্তি। আমেরিকা, ইউরোপ কিংবা চীন ও জাপানের সফলতার নেপথ্যের মূলমন্ত্র হলো তারা পরিশ্রমী এবং তাদের রয়েছে দক্ষ শ্রমশক্তি। তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মোট শ্রমশক্তির কর্মসংস্থানের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। এজন্য তারা জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছে। বৈশ্বিক বাজার আজ তারা নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের জনসম্পদ ছড়িয়ে আছে গোটা বিশ্বে। অন্যদিকে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঈর্ষণীয় হলেও আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়া বেকারত্বের কাছে সব অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বেকারত্ব এখন এক গভীর ও জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিবিএসের হিসাবে প্রতি বছর ২৭ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও সরকারি বা বেসরকারিভাবে কাজ পাচ্ছে মাত্র ১ লাখ ৮৯ হাজার মানুষ। ফলে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষ বেকার থাকছে। আবার ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে আগমন ঘটেছে করোনাভাইরাসের। এটির প্রভাবে কর্মবাজার সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের জোগান আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। লাখো কর্মজীবী ছাঁটাই হয়ে বেকার অবস্থায় রয়েছেন।
দেশে শিক্ষিত যুবকদের তুলনায় কর্মসংস্থানের সুযোগ নিতান্তই কম। ফলে বিপাকে পড়েছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। তারা যেমন প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ পান না তেমনি পারেন না যেমন-তেমন কাজে ঢুকতে। টিকে থাকার সংগ্রামে এদের দৌড়ঝাঁপ করতে না হলে, এদেরও চিন্তা-চেতনায় মিশে থাকত জাতীয় উন্নয়ন ও দেশ সেবা। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তরুণ জনগোষ্ঠীর এ সুবিধা যদি কাজে লাগানো যায়, তবে বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করবে।
সক্ষম মানুষরা যেন কাজ পান, তা নিশ্চিত করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অথচ দেশে কাঙ্ক্ষিত হারে বিনিয়োগ হচ্ছে না। বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগও অপ্রতুল। এক শ্রেণির দুর্নীতিপরায়ণ দুষ্টচক্রের কাছে জিম্মি হয়ে থাকছে দেশের কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি। উদ্যোক্তাদের জন্য বিনিয়োগ পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে নানাভাবে হয়রানির মাধ্যমে হতাশ করা হচ্ছে এদের। দেশের আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম্য, সরকারি নীতি বাস্তবায়নের ধীর গতি ও সীমাহীন দুর্নীতির জন্য দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকেই। ফলে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির প্রয়োজনীয় বিকাশ ঘটছে না। অন্যদিকে মেধার চেয়ে স্বজনপ্রীতি ও অর্থের মানদণ্ড হয়ে উঠেছে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান হাতিয়ার। এসব শ্রেণির মিশন থাকে অসৎদের নিয়ে রাজত্ব ও দলীয় বলয় কায়েম করে সুদে-আসলে টাকার পাহাড় গড়ে তোলা। রাষ্ট্রের অগ্রগতি ও সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম তাদের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। অসংখ্য বেকারের আর্তনাদ তাদের হূদয়কে স্পর্শ করে না। তারা ব্যস্ত রাজনৈতিক নেতাদের পেছনে ছুটতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ যখন উন্নয়নের মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে; তখন সেই স্বপ্নকে কলুষিত করতে তৎপর এসব জাতির মীরজাফররা। এমনকি সোনার বাংলার স্বপ্নদৃষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও বিভিন্ন ভাষণ, বিবৃতি ও লেখায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। মেধাবী তরুণদের ন্যায্য অধিকার হরণ ও তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎকে নষ্ট করার অধিকার কারো নেই।
দেশে কাজের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে অনেকাংশ ব্যর্থ হয়েছি। আমরা কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য না দিয়ে তত্ত্বগত ও মুখস্থ বিদ্যার দিকে ক্রমাগত ঝুঁকে পড়ছি। যার ফলে অনেক চাকরিদাতা দেশের বেকারদের চাকরি না দিয়ে বিদেশ থেকে চড়া দামে লোক এনে কাজ করায়। ফলে দেশের বিশাল কর্মক্ষম শ্রমশক্তির বৃহৎ একটা অংশ কাজের বাইরে থেকে যাচ্ছে। আসলে লোকে বলে চাকরি কোথায়, আর চাকরি বলে লোক কোথায়? প্রতি বছর বিদেশীরা আমাদের দেশে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ধনাঢ্য হচ্ছে, আর আমরা থেকে যাচ্ছি কর্মহীন। তারা আমাদের বাজারকে দখল করে গড়ে তুলছে বড় বড় কোম্পানি এবং প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে হতাশ হচ্ছে দেশীয় স্বল্প পুঁজির উদ্যোক্তারা। শিল্প-বাণিজ্যের সম্পূর্ণ প্রসার ঘটাতে আমাদের পরিকল্পনা অত্যন্ত নড়বড়ে। অনেকে জনসংখ্যাকে বোঝা মনে করেন। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন তো, আমাদের ১৭ কোটি জনগণের ৩৪ কোটি হাত যদি সহযোগিতা ও কর্মের হাতে পরিণত করতে পারতাম, বাংলাদেশ এখন সর্বক্ষেত্রে বিশ্বের রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হতো। আর তাই এখন বেকারত্বকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত জনশক্তি সৃষ্টি অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি উন্নয়নকে টেকসই ও স্থায়ী রূপ দিতে কর্মপরিবেশের উপযোগী শ্রমশক্তি তৈরি করে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ বিদেশি পুঁজির নিগূঢ় স্বীকার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নতুবা আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসবে না।
উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার সঙ্গে কর্মসংস্থানের একটি নিবিড় সম্পর্ক থাকে। তাদের শিক্ষাব্যবস্থা সাজানো হয় দেশ ও বিদেশের শ্রমশক্তির চাহিদা অনুসারে। তারা ‘মাস্টারপ্ল্যান’ করে তরুণ-তরুণীদের জাতীয় উন্নয়নে কাজে লাগায়। অথচ আমাদের প্রচালিত শিক্ষাব্যস্থার সঙ্গে বাস্তবিক কর্মক্ষেত্রের খুব কম মিল আছে। ধরুন, ইঞ্জিনিয়ারিং কোনো বিষয়ে অনার্স, মাস্টার্স সম্পন্ন করা শিক্ষার্থী হলেন ব্যাংকার, আবার হিসাববিজ্ঞানে পড়া শিক্ষার্থী হলেন একজন জেলা প্রশাসক। মানুষের যে কোনো পেশা বেছে নেওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু একজন ৬-৭ বছর ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে দক্ষ হয়ে যদি ব্যাংকার হন তাহলে তার অর্জিত ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা থেকে জাতি বঞ্চিত হবে না? পার্থক্য কি শুধু চাকরি পরীক্ষার কিছু ধাপ যেখানে মুখস্থ বিদ্যার প্রয়োগ বেশি। এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে নতুবা বেকারত্ব সংকট আগামী দিনগুলোতে আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষার মান। একই সঙ্গে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে নিতে হবে নানাবিধ উদ্যোগ। এর জন্য শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সর্বস্তরের মানুষের জাগরণ প্রয়োজন। দেশের শিক্ষাঙ্গন থেকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করতে হবে। নিয়োগ বাণিজ্যের প্রমাণ পেলেই নিশ্চিত করতে হবে কঠিন দণ্ড। শিক্ষকদের সঙ্গে দিনদিন শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতা কমে যাচ্ছে। মুক্তবুদ্ধির চর্চার জায়গা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। আর এসব কারণেই প্রয়োজন আমাদের শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি।
বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, যারা লেখাপড়া করেননি বা অল্প লেখাপড়া করেছেন সবচেয়ে কম বেকারত্বের হার তাদের মধ্যেই। এজন্য সবার আগে আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনা জরুরি। বেকার থাকার থেকে স্বল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসা অথবা অন্য যে কোনো কাজ করুন। মেধা থাকলে সফলতা আসবেই। যে সমস্ত মানুষ চেষ্টা করে না, তারা প্রথম থেকেই ব্যর্থ। জীবনে সবচেয়ে বড় বিপদ হলো ঝুঁকি না নেওয়া। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি বিশ্বকে জানতে হবে। প্রযুক্তির এই যুগে হাজারো উপার্জনের উৎস রয়েছে। সুযোগ রয়েছে আউটসোর্সিং, প্রোগ্রামিং, ফ্রিল্যান্সিং, অডিও-ভিডিওসহ প্রযুক্তিনির্ভর অনেক ধরনের কাজ। তবে সমস্যা শুধু বেকার জনগোষ্ঠীদের নিয়েই নয়, বরং কর্মজীবী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও একটা বিশাল অংশের আয় তাদের জীবনধারণের জন্য উপযুক্ত নয়। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার সঙ্গে নাগরিকের আয়ের সামঞ্জস্য না থাকায় প্রকট হচ্ছে সামাজিক সংকট। এজন্য পরিকল্পিত পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ নিতে হবে নানাবিধ সমন্বিত উদ্যোগ।
বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাতারাতি পরিবর্তন যে আসবে না, তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। কাজেই বেকার সমস্যাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। আর কালক্ষেপণ না করে দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের যথাযথ মূল্যায়ন, দেশীয় উদ্যোক্তাদের উৎসাহ ও প্রয়োজনীয় সহয়তা প্রদান জরুরি। অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে বেকারত্ব নামক অভিশাপ থেকে আমরা অনেকাংশ রক্ষা পাব। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে, তবেই বেকারত্বের হাত থেকে রক্ষা পাবে জাতি।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া