দৃষ্টিজয়ীদের বন্ধু

সমাজসেবী নাজিয়া জাবীন

ছবি : বাংলাদেশের খবর

ফিচার

দৃষ্টিজয়ীদের বন্ধু

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ২ মার্চ, ২০১৯

এমন কিছু মানুষ আমাদের দেশে আছেন, যারা নিভৃতে মানবকল্যাণে নিজেদের পুরো অস্তিত্বকে সঁপে দিচ্ছেন। ব্যক্তিসত্তাকে মানবতার সত্তায় রূপান্তরিত করেছেন। তেমনি এক সমাজসেবী নাজিয়া জাবীন। আজ তিনি দেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে গেছেন দৃষ্টিজয়ীর মর্যাদায়। দীর্ঘ এগারো বছরের সংগ্রাম আর প্রতিজ্ঞায় এখন তিনি অনেকটা স্বস্তিবোধ করেন দৃষ্টিজয়ীদের জন্য কিছু একটা করতে পেরে। যদিও তিনি মনে করেন এখনো যেতে হবে অনেকটা পথ। এক সাক্ষাৎকারে দৃষ্টিজয়ীদের বন্দনা করলেন তার সামগ্রিক কথোপকথনে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সালেহীন বাবু

আপনি একাধারে লেখক, একজন ছড়াকার ও শিশুসাহিত্যিক। গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে ব্রেইল পদ্ধতি নিয়ে কাজ করার ভাবনার সূচনাটা এলো কোথা থেকে?

আমার লেখা প্রথম ছড়ার বইটি যখন প্রকাশিত হলো, সেই অনুষ্ঠানে অনেক দৃষ্টিজয়ী বন্ধু এসেছিল। সে সময় আমি ‘প্রেরণা’ নামে দৃষ্টিজয়ীদের একটি সংগঠনে কাজ করতাম। বইটি যখন প্রকাশ হয়, আমার চোখ আটকে গেল একটা জায়গায়। দেখলাম, আমার এই বইয়ে কয়টা পাতা আছে তা একজন গুনে গুনে দেখছেন। কেউ কেউ আবার বইয়ের আকারটা হাত বুলিয়ে অনুধাবনের চেষ্টা করছেন। আমি বুঝতে পারি তাদেরও ইচ্ছে জাগে বই পড়ার। এই দৃশ্যগুলো আমাকে প্রচণ্ড নাড়া দেয়। বুঝি তাদেরও পড়ার অধিকার আছে। সেই থেকে শুরু।

 

এগুলেন কীভাবে?

অন্যান্য দেশে যে কোনো বই বের করলে তার অবশ্যই একটা সিডি ও ব্রেইল ভার্সনের বই থাকে। এ কারণেই দৃষ্টিজয়ী বন্ধুরা সহজেই সৃজনশীল বই পড়ার সুযোগ পায়। আমি ভাবতে লাগলাম আমাদের দেশে এই অবস্থা নেই কেন? আমি ব্রেইল প্রেস সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করলাম। সে সময় একটি সরকারি ব্রেইল প্রেসের খোঁজ পাই। সেটা ছিল টঙ্গী। তবে এটা প্রায়ই বন্ধ থাকে। ২০০৮ সালে ছড়ার বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিই। ২০০৯ সালে আমার লেখা একটি শিশুতোষ ছড়ার বই ‘ছড়ার তালে মনটা দোলে’ নামে একটা বই ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রকাশ করি।

 

এ বইটি কি ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের প্রথম বই?

হ্যাঁ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রকাশিত প্রথম শিশুতোষ ছড়ার বই। দেশে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ব্রেইল পদ্ধতি ব্যবহার হলেও সৃজনশীল পড়াশোনা বা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ব্রেইল পদ্ধতিতে ছাপানো বই না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত হয়ে আসছিল দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীরা। আমার এই বই প্রথম এদেশে ব্রেইল পদ্ধতিতে শিশুতোষ ছড়ার বই হিসেবে প্রকাশ করা হয়।

 

দৃষ্টিজয়ী বন্ধুর মর্মার্থ কী?

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষকে আমরা অনেকেই নানা নামে ডেকে থাকি। এতে ওরা কষ্ট পায়। বিশেষ করে এদের মধ্যে যারা পড়াশোনা করে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে, তাদের দৃষ্টিজয়ী ছাড়া অন্য নামে ডাকতে লজ্জা করে। যেখানে সুস্থ থেকে অনেকে আড্ডাবাজি, নেশা করে বিপথে পা বাড়াচ্ছে, সেখানে দৃষ্টিজয়ীরা এগুচ্ছে সফলতার প্রত্যয়ে।

 

ব্রেইল পদ্ধতিতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশকের ভূমিকায় কোন সময় থেকে অবতীর্ণ হলেন?

আমার বইটি যেসব দৃষ্টিজয়ী বন্ধুকে দিয়েছিলাম, তাদের স্কুলে গিয়ে দেখলাম বইটির ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা উঁচু উঁচু অক্ষরগুলো সমান হয়ে গেছে। বইটি তারা এতবার পড়েছে যে, পড়তে পড়তে লেখা বসে গেছে। তারা বইটি আর পড়তে পারছে না। তখন ভাবলাম, তাহলে কী করা যায়? এরপর আমারই লেখা ‘বিনির সাথে পুতুলের বিয়ে’ বইটির ব্রেইল বের করলাম। একসময় মনে হলো, তাদের পড়ার চাহিদা এত বেড়ে গেছে যে শুধু আমার লেখা বই দিয়ে তাদের তৃষ্ণা মেটানো সম্ভব নয়। তখন আমি ব্রেইল পদ্ধতিতে সাহিত্যের বই প্রকাশের জন্য বিভিন্ন প্রকাশকের কাছে গেলাম। সাহিত্য প্রকাশের মফিদুল হক প্রথম এগিয়ে এলেন। তিনি প্রায় সাতটি বই আমাকে দিলেন। বললেন, তুমি এগুলো ব্রেইল কর। আমি আছি তোমার সঙ্গে। এই সাতটি বই নিয়ে আমরা ২০১১ সালে বই মেলায় এলাম। ভেবে দেখলাম, মানুষকে জানান দিতে হবে।

যখন সাধারণ মানুষ জানবে, দৃষ্টিজয়ীরা পড়তে জানে কিন্তু তাদের বই নেই, তখন আমরা ব্রেইল পদ্ধতিতে সাহিত্য রচনার জন্য দাবি তুলতে পারব। একটা জোরালো আওয়াজ বের হবে। ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি আমাদের সহায়তা করল। আমরা একটি স্টল পেলাম। দেখা গেল প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। দৃষ্টিজয়ী বন্ধুদের ভিড় বাড়ছে। তারা গড়গড় করে পড়তে পারে। অথচ তাদের হাতে বই নেই। তখন আমাদের দুটি স্টল দেওয়া হলো। মানুষ এসে ভিড় করে। দৃষ্টিজয়ী বন্ধুদের পড়া শোনে। ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি আমাদের স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনার সহায়তায় প্রথম ব্রেইল বইটি বের করল। বইটি হলো সৈয়দ শামসুল হকের ছোটদের জন্য লেখা বঙ্গবন্ধুর বীর গাথা। মেলামঞ্চে এর মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা এতে নতুন করে অনুপ্রাণিত হলাম।

 

স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা থেকে কী ধরনের ও কতটি বই বের হয়েছে?

এ পর্যন্ত আমরা ৬৭টি বই ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রকাশ করেছি। আমি এসব বই দৃষ্টিজয়ী বন্ধুদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করি।

উল্লেখযোগ্য কার কার বই এ প্রকাশনা থেকে বের হয়েছে?

কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল, কবীর চৌধুরী, হালিমা খাতুন, নীলিমা ইব্রাহীম, মফিদুল হক, সেলিনা হোসেন, লুৎফর রহমান লিটনের ছড়ার বইসহ অনেক নামি লেখকের বই ব্রেইল পদ্ধতিতে বের হয়েছে।

 

প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় কী পর্যাপ্ত ব্রেইল বই পাওয়া যায়?

প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত ব্রেইল বই পাওয়া যায়।

 

দৃষ্টিজয়ীদের পরীক্ষায় ব্রেইল পদ্ধতি ছাড়া কি অন্য কোনো বিকল্প পদ্ধতি নেই?

দৃষ্টিজয়ী বন্ধুরা টেপ শোনে, ক্লাসে স্যারের লেকচার রেকর্ড করে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় পরীক্ষার হলে। সেখানে তাদের একজন হ্যান্ডরাইটারের দরকার হয়। কারণ শিক্ষক তো আর ব্রেইল চেক করতে পারেন না। এসব নিয়ে দৃষ্টিজয়ী বন্ধুদের প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষা কতটুকু মানসম্মত হয় তা ভাবার বিষয়।

 

এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

আমার মনে হয়, ব্রেইল শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া উচিত।

 

দৃষ্টিজয়ী অভিভাবকদের আলাদাভাবে কাউন্সেলিং করার কোনো ব্যবস্থা আছে কি?

আমি মনে করি, দৃষ্টিজয়ী এবং তাদের অভিভাবকদের জন্য কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করা দরকার। এটার অভাব আমাদের দেশে আছে। তাদের জন্য আলাদা তথ্যকেন্দ্রও নেই। এটিও দরকার।

 

একসময় ছিল দৃষ্টিজয়ীদের পাশে শুধু আপনি ছিলেন। এখন তো আগের থেকে অনেক সচেতনতা বেড়েছে।

এখন ওরা আর আগের মতো একা নয়। ওদের জন্য এখন অনেক সংগঠন এগিয়ে আসছে, অনেক বড় বড় মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি সরকারও এ বিষয়ে অনেক সজাগ হয়েছে।

 

কোনো ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা থাকলে বলতে পারেন।

আমার স্বপ্ন বাংলাদেশের সব শিশুর হাতে বই থাকবে। সব শিশু সমান অধিকার পাবে। কোনো শিশু পড়াশোনার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। স্বপ্ন দেখি একটি নলেজ সেন্টার করার।

এ ছাড়া একটি ব্রেইল লাইব্রেরি তৈরি করব। ওদের মুখে ফুটে থাকা সামান্য হাসিও আমার কাছে অমূল্য রতন। হীরার চাইতেও ওই হাসিটা আমার কাছে অনেক অনেক দামি।

যখন দেখি  ব্রেইল বইটি নিয়ে ওরা দেখছে, পড়ছে- সেই দৃশ্যটি আমার কাছে সবচেয়ে তৃপ্তির। আমি যেন আমার জীবনের শেষ পর্যন্ত ওদের সঙ্গে থাকতে পারি। ওদের ভালো লাগা, আনন্দের মাঝে যেন আমি থাকতে পারি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads