মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট ক্ষতিকর পদার্থ এবং তা নির্গমনের কারণে স্বাভাবিক পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়লে তাকে দূষণ বলে। পরিবেশ দূষণ বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ। পরিবেশ দূষণের কারণে পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। এছাড়া জীবজগতের স্বাভাবিক জীবন এবং স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশও ব্যাহত হয়। ফলে পরিবেশের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়। বর্তমান সময়ে পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো বর্তমানের শিল্পায়ন।
অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন শহরের ওপর প্রভাব ফেলছে। জলাভূমি ভরাট করে বিভিন্ন এলাকায় বহুতল বাড়ি বানানোর কারণে শহরের বিভিন্ন অংশ বন্যার সময় প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে ছোট ছোট নগরগুলো পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে। অবৈধ দখল রোধ এবং জলাভূমি ও খালগুলোতে বিনিয়োগ এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। না হলে বাংলাদেশ বসবাসের উপযোগিতা আরো হারাবে।
দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম। একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে অবস্থান অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে এখনই বিশেষ করে শহর এলাকায় পরিবেশগত অবনতি ও দূষণরোধে কাজ করতে হবে। জলাভূমি দখল ও বিপজ্জনক বর্জ্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে ফেলাসহ দূষণ ও পরিবেশগত অবনতির ফলে আমাদের জনস্বাস্থ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। সাধারণ জনগণ সিসা দূষণের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ কারণে বিশেষ করে শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ (আইকিউ) বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত ও মৃতশিশু প্রসবের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে। পরিবেশ দূষণের প্রধান শিকার নারী ও শিশু। বিশেষ করে শব্দদূষণ শিশুদের অবসাদগ্রস্ত করে তোলে। তারা বধিরতায় আক্রান্ত হয়। তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। তারা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে। আর অতিরিক্ত সিসা শিশুদের রক্তশূন্যতা সৃষ্টি করে। তারা ঠিকমতো খেলেও অপুষ্টির শিকার হয়।
ক্যানসার ও হূদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন বায়ুদূষণের মধ্যে থাকলে বা এরকম পরিবেশে কাজ করলে ফুসফুসের ক্যানসার এবং হূদরোগ দেখা দিতে পারে। এমনকি তা মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করতে পারে। শব্দদূষণের কারণে হাইপার টেনশন, আলসার, হূদরোগ, মাথাব্যথা বা স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে। এমনকি অতিরিক্ত শব্দের পরিবেশে থাকলে শিশুর জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে। শব্দদূষণের কারণে প্রেশার, শ্বাসকষ্ট ও হজমের সমস্যা তৈরি হতে পারে।
পরিবেশ রক্ষায় আইন আছে, নীতিমালা আছে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। এসব আইন ও নীতিমালা ভঙ্গ করলে শাস্তির বিধানও আছে; কিন্তু অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে না। সরকারের সদিচ্ছাই পারে পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা নিতে। সময়ের প্রয়োজনেই তা করতে হবে। তা না হলে সামনে পরিবেশ দূষণের আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
বর্তমান বিশ্বে মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু দূষণ প্রক্রিয়া। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, মানুষ এখন পারমাণবিক বোমার চেয়ে পরিবেশ দূষণকে বেশি ভয় পায়। পুরো বিশ্বের মানুষ এই দূষণ নিয়ে বড়ই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে। এমনকি বিশ্ব রাজনীতিকরা যেখানেই সম্মেলন করছেন, সেখানেই একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে, পৃথিবীকে কীভাবে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা যায়।
সভ্যতার ক্রমবিকাশের পাশাপাশি বিজ্ঞানের উন্নতি সাধন হয়েছে, আমাদের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছে; কিন্তু প্রকৃতির ক্ষতি করতে আমরা দ্বিধাবোধ করিনি। আমরা আমাদের ইচ্ছামতো নগরায়ন করেছি, শিল্প-কারখানা তৈরি করেছি, জমির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার বৃদ্ধি করেছি, নদীদূষণ ঘটিয়েছি, পাহাড় কেটেছি, গাছ কেটেছি নির্বিচারে, আকাশের নির্মল বায়ুকে করেছি দূষিত। তারই ফলে প্রকৃতি ইতোমধ্যে আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। প্রকৃতির এই বিরূপ আচরণ থেকে নিজেদের রক্ষায় এখনই সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়