টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, জমি দখল, চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, বিদেশে কর্মীপাঠানোর নামে প্রতারনা, কমিশন বাণিজ্য, মানিলন্ডারিং, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগে দেড়শতাধিক প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক আমলাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়ম তদন্তে নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অনুসন্ধানে কাজ শুরু করেছে ৫ টি অনুসন্ধান কমিটি। বেশ কিছু ব্যক্তির নামে তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। এছাড়াও দুদকে আরও অভিযোগ আসছে। গত রোববার দুদকের চেয়ারম্যানের কাছে ৪১ প্রভাবশালীর তালিকা ও সম্পদ বৃদ্ধির পরিসংখ্যান দিয়ে অনুসন্ধানের আবেদন করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতন হয়েছে। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পর মধ্য দিয়ে প্রশাসনে বড় পরিবর্তন এসেছে। গঠন করা হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ক্ষমতার পট পরিবর্তনে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে থলের বেড়াল। ইতোমধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার সিন্ডিকেটের যারা ঘুষ হিসেবে বস্তা বস্তা টাকা নিতেন সে বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিস থেকে এই টাকা আদায় করা হতো। এজন্য তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসে নিয়োগ বাণিজ্য করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। অনুসন্ধান দলে আরও রয়েছেন দুদকের উপপরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদিন, সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, মোহাম্মদ জিন্নাতুল ইসলাম ও মো. নাছরুল্লাহ হোসাইন।
আসাদুজ্জামান খান কামাল ছাড়াও যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তারা হলেন মন্ত্রীর সাবেক পিএস ও অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব হারুন অর রশিদ বিশ্বাস, যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন, সহকারী একান্ত সচিব মনির হোসেন ও জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু।
এ বিষয়ে দুদকের উপ-পরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, বেশ কিছু সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এ তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে।
এছাড়া অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, আলোচিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম (এস আলম) ও পদ্মা ব্যাংকের পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে। এস আলমের দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকের উপ-পরিচালক ইয়াসিন আরাফাতের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। আর চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকের উপ-পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেনকে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
দুদক সূত্রে আরও জানায়, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) বেশ কিছু প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্যের সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রভাবশালীর দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু হবে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সদ্য পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, সাবেক ডাক, টেলিযোগযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন, সাবেক সংসদ সদস্য শাজাহান খান, খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান করছে দুদক। দেওয়া হয়েছে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট’ (এমএলএআর)।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী, ঢাকা-২০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের নেতৃত্বাধীন একটি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এই তালিকায় আছেন ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন, চৌধুরী, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামাল ও মেয়ে নাফিসা কামাল। এ বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর দুদকের উপপরিচালক নুরুল হুদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। এছাড়া - ঢাকা উত্তর সিটির ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের (ভাটারা এলাকা) কাউন্সিলর মো. শফিকুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ, বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন ওরফে স্বপনসহ আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতার নামও রয়েছে এই তালিকায়।
অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে দুদকে মামলার সিদ্ধান্ত আগে নেওয়া হলেও থেমে যাওয়া এসব অভিযোগগুলোও নতুন করে অনুসন্ধান করা হবে। এসব অভিযোগে অভিযুক্ত রয়েছেন প্রায় ২০ সাবেক এমপি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে দুদকের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্রটি জানায়, অনুসন্ধানে থাকা অন্যান্য এমপিদের বিষয়েও আমাদের অনুসন্ধান কার্যক্রম নতুন করে শুরু হচ্ছে। আমাদের কোনো কাজ থেমে নেই। আমরা মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী চেষ্টা করি যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদেরকে আইনের সম্মুখীন করা হবে।
দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, আমরা দুদকের আইন ও বিধি অনুযায়ী কাজ করছি। যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসবে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুদককে অধিকতর কার্যকর করতে হলে দুদকের আইন ও বিধিতে সংস্কার আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, দুদককে পুনর্গঠন করতে হবে। দুদককে ঠিক করে দিলে তারা অটোপাইলটে চলে যাবে। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করবে। দুর্নীতি রোধে দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
দুদকে সংস্কার প্রয়োজন জানিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে প্রত্যাশিত নতুন বাংলাদেশে রাষ্ট্রকাঠামোর আমূল পরিবর্তনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে দুদককে ঢেলে সাজাতে হবে। অন্যথায় দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক ও জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, ১৫ বছর ধরে লাল ফিতায় বন্দি থাকা অন্তত ৯৫টি ফাইল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সক্রিয় করতে চাচ্ছে দুদক। এসব ফাইলে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, ফরিদপুরের এমপি ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া কয়েকজন ব্যবসায়ী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তার অভিযোগ জমা রয়েছে। সেগুলো নিয়েও এখন কাজ করতে চান কর্মকর্তারা। ইতোমধ্যেই অনেক প্রভাবশালী পুলিশ ও কর্মকর্তাকে রাখা হয়েছে নজরদারিতে। ফ্রিজ করা হয়েছে অনেকের ব্যাংক হিসাব।
দুদক সূত্র জানায়, যাদের বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান চালাবে তারা হচ্ছেন- আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আমীর হোসেন আমু, সাবেক ভুমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পংকজ দেবনাথ, সাবেক সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা আফসার উদ্দিন মাস্টার, বনানী গোল্ডেন ক্লাবের আবদুল আওয়াল ও আবুল কাশেম, জামাল হোসেন, সাবেক সাংসদ জাফর আলম, পিরোজপুরের সাবেক সাংসদ এমএ আউয়াল, সাবেক সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারী, সাবেক স্বতন্ত্র সাংসদ কামরুল আশরাফ খান পোটন, সাবেক সাংসদ আনোয়ারুল আবেদীন খান, সাবেক এমপি শামসুল হক ভূঁইয়া, শামসুল হক টুকু, টিপু মুনশি, নসরুল হামিদ বিপু, সাধন চন্দ্র মজুমদার, আনিসুল হক, ডা. দীপু মনি, ডা. এনামুর রহমান, জাহিদ মালেক, তাজুল ইসলাম, জুনাইদ আহমেদ পলক, মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ফরিদুল হক, গোলাম দস্তগীর গাজী, ইমরান আহমদ, জাকির হোসেন, কামাল আহমেদ মজুমদার, জাহিদ আহসান রাসেল, নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, শাহজাহান খান, হাছান মাহমুদ, কামরুল ইসলাম, হাসানুল হক ইনু, মহিবুর রহমান, বেনজীর আহমেদ, সরওয়ার জাহান, শরিফুল ইসলাম জিন্না, শহিদুল ইসলাম বকুল, শেখ আফিল উদ্দিন, ছলিম উদ্দীন তরফদার, কাজী নাবিল আহমেদ, এনামুল হক, মামুনুর রশিদ কিরন, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, মেহের আফরোজ চুমকি, কাজিম উদ্দিন আহমেদ, স্বপন ভট্টাচার্য, আ.স.ম. ফিরোজ, নূরে আলম চৌধুরী, আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন, শেখ হেলাল উদ্দিন, জিয়াউল রহমান।
এ ছাড়াও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আলোচিত সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি (বহিষ্কৃত) ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, যুবলীগ নেতা জি কে শামীম, আরেক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হাজি রবিউল ইসলাম ও আতাউর রহমান আতাসহ অন্তত ৭০ জন নেতার নাম রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, প্রভাবশালী অনেক রাজনৈতিক নেতার ওপর নজরদারি রয়েছে। অনেকের দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে দুদকে। অভিযোগগুলো তদন্ত করে তাদের নোটিশ দেওয়া হবে। তারপরও আমরা অনুসন্ধানে যাব। তাছাড়া ক্যাসিনোকান্ডে যারা জড়িত ছিল, তাদের বিষয়েও আমরা নতুন করে তদন্ত করব। যারাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের বিষয়ে পিছু হটবে না দুদক। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ঘুষ, সরকারি সম্পত্তি দখল, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা বিষয়ে দুদকে অভিযোগ আসছে। বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে টিআর, কাবিখা কর্মসূচি বাস্তবায়নে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। আবার কারোর বিরুদ্ধে ক্যাসিনো ব্যবসা ও অর্থ পাচারের অভিযোগ আছে। অনুসন্ধান করে অভিযোগ প্রমাণ হলে ছাড় দেওয়া হবে না। ক্যাসিনোকান্ডে যারা জড়িত ছিল তাদের বিষয়েও আমরা নতুন করে তদন্ত করব। যারাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের বিষয়ে পিছু হটবে না দুদক।