দেশে তরল ও গুঁড়ো দুধে ভেজাল আতঙ্কের মধ্যদিয়েও দেশে প্রতি বছরই দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। জাতীয় ডেইরি উন্নয়ন ফোরামের তথ্য উপাত্ত বলছে, গত ১০ বছরে দেশে দুধ উৎপাদন প্রায় চার গুণ বেড়েছে। তাদের মতে, বর্তমানে এই শিল্পের অবস্থা ভালো, এগিয়ে যাচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে ক্ষুদ্র খামারিদের স্বল্প সুদে ঋণ দিতে হবে। দুগ্ধশিল্প বাংলাদেশের একটি ক্রমবধর্মান শিল্প। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে তরল দুধের চাহিদা প্রায় পুরোটাই মেটায় দেশীয় খামারি ও দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিগুলো। এ খাতে গড়ে উঠেছে প্রায় ৮টি বড় কোম্পানি। অতীতে এদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রামীণ জনগোষ্ঠী গতানুগতিক পদ্ধতিতে দুগ্ধ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও বতর্মানে তা বাণিজ্যিক আকার ধারণ করেছে। তবে সে তুলনায় কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হচ্ছে না এ খাতে। বর্তমানে দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে বেকারি ও আইসক্রিম শিল্পে ব্যবহার হচ্ছে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য। প্রায় ৩০-৪০ হাজার কোটি টাকার দুগ্ধজাত পণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজারে মিল্কভিটার পাশাপাশি আছে বেসরকারি আরো ১২-১৪টি প্রতিষ্ঠান। উদ্যোক্তাদের মতে, গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা ও গুঁড়ো দুধ আমদানিতে শুল্ক কমানোর কারণে এখাতে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক রায়হানুল হাবীব বলেন, দুগ্ধশিল্পের সবচেয়ে বড় সমস্যা সমন্বিত বিপণন ব্যবস্থা নেই। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্পন্ন দুধ পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষ নানা ধরনের তরল পানীয় গ্রহণে আগ্রহী অথচ পুষ্টিগুণ দুধেই সবচেয়ে বেশি। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগ দরকার।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেন, দুধ উৎপাদনের জন্য ভারতে কৃষকদের ভর্তুকি দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের দুগ্ধ খামারিরা ভর্তুকি পাচ্ছেন না। অথচ দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদা পূরণে খামারিরা নিরলসভাবে কাজ করছেন। দুগ্ধশিল্পের প্রসারের জন্যই খামারিদের পাশে দাঁড়াতে হবে সরকারকে। তাদের প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। বৈঠকে প্রাণ ডেইরি লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক মো. মুনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমরাও চাই গুঁড়ো দুধ আমদানি বন্ধ হোক। তবে স্থানীয় পর্যায়ে দুধের উৎপাদন না বাড়িয়ে আমদানি বন্ধ করা যাবে না। অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য প্রকাশ দুগ্ধশিল্পের বিকাশের জন্য বাধা তৈরি করে। এতে খামারি, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা- সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে যে পরিমাণ দুধ উৎপাদন হয়, তার মাত্র ৭ শতাংশ বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত হয়ে বাজারে আসে। কিন্তু বাকি ৯৩ শতাংশ দুধ কোনো ধরনের মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বাজারে বা ভোক্তার বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করা হয়। এছাড়া সংরক্ষণজনিত কারণে উৎপাদিত দুধ অপচয়ের ঘটনাও ঘটছে। বিশেষ করে গরমের সময় উৎপাদিত দুধের একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর বলেন, দুধ সুষম খাবার। এটি সব বয়সী মানুষের জন্য দরকার। চরাঞ্চলগুলোতে খামার করার জন্য সরকার জমি ইজারা দেওয়ার ব্যবস্থা করলে ডেইরি শিল্প খাত আরো বাড়বে। তিনি আরো বলেন, দেশে সংকর জাতের গরু সংখ্যা কম, দেশি গরুর সংখ্যা বেশি। দুধের উৎপাদন বাড়াতে হলে সংকর জাতের গরুর সংখ্যা বাড়াতে হবে।
দেশে দুধের বাজারে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, বিক্রীত পণ্যের ৯০ শতাংশই বিক্রি হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে। বাজারে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দুধ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমারস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে গরুর খামারির সংখ্যা প্রায় ৮১ হাজার। ৫০ হাজারের বেশি খামারি উদ্যোক্তা স্নাতক পাস। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ক্রমবর্ধমান জিডিপিতে পশুসম্পদের অবদান ৩ দশমিক ২১ শতাংশ। দেশের মোট কর্মসংস্থানের প্রত্যক্ষভাবে ২১ শতাংশ এবং মোট আমিষের ৮ শতাংশ আসে দুগ্ধ সেক্টর থেকে। বর্তমানে এই সেক্টরে বহু বেকার শিক্ষিত যুবক বিনিয়োগ করছে। অনেক প্রবাসীও এই সেক্টরে বিনিয়োগ করেছে। প্রাণিসম্পদ বিভাগের হিসাবমতে, যেখানে দেশে বছরে ১৪.৪৮ মিলিয়ন টন দুধের চাহিদা রয়েছে সেখানে উৎপাদন হয় মাত্র ৬.৯৭ মিলিয়ন টন এবং এই বিশাল ঘাটতি পূরণের জন্য আমদানি বাণিজ্যই প্রধান অবলম্বন। অথচ দেশে উৎপাদিত ও আমদানীকৃত দুগ্ধজাত সামগ্রীর গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। অতি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর-বি) তরল দুধের ওপর একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে, স্থানীয় বাজারে পাস্তুরিত দুধের ৭৫ শতাংশই নিরাপদ নয়।
দুগ্ধশিল্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৯৭৩ সালে সরকারিভাবে পাবনা, টাঙ্গাইল, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা এই পাঁচ জেলাকে দুধ উৎপাদনের জন্য অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এলাকা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। এর পরের বছর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন- মিল্কভিটা। মূলত তখন থেকেই দেশে বৃহদাকারে দুধের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ শুরু হয়। দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের উপকারিতা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার উদ্যোগে ২০০১ সাল থেকে প্রতি বছর জুন মাসের প্রথম দিনে পালিত হয় বিশ্ব দুগ্ধ দিবস। এবারো যথাযথভাবে দিবসটি পালন করা হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুল জব্বার দুগ্ধ দিবস উপলক্ষে এক বিবৃতিতে বলেন, দেশে দুগ্ধশিল্প অনেক পিছিয়ে আছে। বর্তমানে দেশে দুধের চাহিদা বছরে ১৪৬ দশমিক ৫১ লাখ টন। উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৭২ দশমিক ৭৫ লাখ টন। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যে প্রতিদিন অন্তত ২৮০ মিলিলিটার দুধ গ্রহণ করা উচিত। অথচ আমরা মাথাপিছু প্রতিদিন দুধ গ্রহণ করছি মাত্র ১২৫ দশমিক ৫৯ মিলিলিটার।
দেশে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো একসঙ্গে দৈনিক গড়ে সাড়ে চার লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে। বাজার থেকে দুধ সংগ্রহের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে সমবায় অধিদপ্তরের সমবায়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লিমিটেড (মিল্কভিটা)। তবে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের দুধ সংগ্রহ কার্যক্রম গুটিকয়েক জেলায় সীমাবদ্ধ। এরপরই রয়েছে ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজ (আড়ং)। এছাড়া প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ (প্রাণ ডেইরি), আকিজ গ্রুপ, রংপুর ডেইরি ফুড অ্যান্ড প্রডাক্ট লিমিটেড, আফতাব ডেইরি, ইবনে সিনা, আমেরিকান ডেইরি, আবদুল মোনেম গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ করে। পাশাপাশি দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন ও গুঁড়ো দুধ বিপণনে সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ বাজারে প্রবেশ করেছে এসিআই। দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া গেলে শিল্পটিতে আরো বিনিয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের পরিচালক বলেন, দুধের উৎপাদন বাড়াতে খামারি পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, খামার পর্যায়ে গরুর দুধ দোহনপদ্ধতি অস্বাস্থ্যকর, যা এই খাতে একটি বাধা। দুধ দোহনের পর চিলিং সেন্টারে (শীতলীকরণ কেন্দ্র) পাঠাতে অনেক সময় লাগে। মাঠপর্যায় থেকে যদি এসব নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাহলে মানসম্পন্ন দুধ উৎপাদন এবং দুধ নষ্ট হওয়া ঠেকানো সম্ভব। আর এ শিল্পকে বিকশিত করতে ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তা পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, দুগ্ধশিল্পের প্রসারে সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। সেখানে বিনিয়োগনীতি, গবেষণা ও সম্প্রসারণনীতি, তদারকি কাঠামো, কৃষক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষানীতি থাকতে হবে। এসব নীতি বাস্তবায়নের পাশাপাশি প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন।
আশার খবরটি হলো, শিল্পে এখন শিক্ষিত খামারিরা যুক্ত হচ্ছে। তাই প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করলে দেশে যেমন দুধের ঘাটতি পূরণ হবে, অপরদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। যদিও দেশে কয়েক বছর ধরেই দুধ উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু উৎপাদন বাড়লেও তা চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়। তাই দুধ উৎপাদন চাহিদা অনুসারে না হওয়ার কারণে আমদানিও বাড়ছে। গুঁড়ো দুধ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকতে হচ্ছে দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের। দুধ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত খামারিদের একটি বড় অংশ নারী। এমন প্রেক্ষিতে আশা করা হচ্ছে, সরকারের প্রণোদনা পেলে দুগ্ধ উৎপাদনের বৃদ্ধির এই ধারা দ্রুত বিকাশের পাশাপাশি দেশের সম্পূর্ণ চাহিদা মিটাতে সক্ষম হবে। সাশ্রয় হবে গুঁড়ো দুধ আমদানির হাজার কোটি টাকা। অনেকের ধারণা যে টাকা গুঁড়ো দুধ আমদানিতে ব্যয় হয় অথবা সরকার আমদানি শুল্ক ছাড় দেয় তা যদি এই দুগ্ধ শিল্প বিকাশে প্রণোদনা বা ঋণ সহায়তা দেওয়া হয় তাহলে দেশে দুধের ঘাটতি তো থাকবেই না বরং রপ্তানি করা সম্ভব হবে। আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার, আমাদের ডেইরি শিল্প শুধু দুগ্ধ উৎপাদনেই সীমিত নয়। এর সাথে ব্যাপক ও বহুমুখী কর্মসংস্থান ও শিল্প সম্ভাবনা জড়িত। যেমন দেশব্যাপী ডেইরি ফার্মের মাধ্যমে গাভী পালন হলে বেকার যুবক-যুবতীরা বিদেশগামী হবে না বা চাকরির পেছনে ছুটবে না। স্থানীয়ভাবে ছোটবড় ডেইরি ফার্ম গড়ে উঠলে গ্রামীণ উন্নয়ন দ্রুত ত্বরান্বিত হবে। গাভী পালনের ফলে দেশে গরু উৎপাদন বাড়বে, এতে দেশে মাংসের চাহিদা পূরণ হবে। বিকশিত হবে আমাদের চামড়া শিল্প। তরল দুধের পাশাপাশি গুঁড়ো দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে দেশ। আরো একটি বিরাট পরিবেশবান্ধব লাভ আছে। আর সেটি হলো, ডেইরি ফার্ম বিকশিত হলে প্রচুর গোবর উৎপাদনের মাধ্যমে দেশে প্রাকৃতিক সারের ব্যবহার কৃষিজ উৎপাদনে সামগ্রিকভাবে কল্যাণ বয়ে আনবে।