প্রতিবছর কোরবানির ঈদের পর এবং বর্ষা মৌসুমে ডিমের দামে কিছুটা ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যায়। তবে সেটা দুই থেকে তিন সপ্তাহের বেশি থাকে না। ফের কমে আসতে শুরু করে দাম। কিন্তু এবার পরিস্থিতি পুরোটা ব্যতিক্রম। কোরবানি হয়ে গেছে পুরো দুই মাস। এ পুরোটা সময়ই বাজারে অস্থিতিশীল ছিল ডিমের দাম। দিন যত যাচ্ছে আরো বাড়ছে এ পুষ্টিপণ্যের দাম।
এর আগে দেশে কখনো ডিমের এত দরস্ফীতি ঘটেনি। শেষ ২০১২ সালে বার্ড-ফ্লুর কারণে দেশে খামারিদের প্রচুর লোকসান হওয়ায় ডিমের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছিল। ওই বছর জুলাই মাসে প্রতি ডজন ফার্মের ডিমের দাম উঠেছিল ১১০ টাকা পর্যন্ত। তবে সেটা ছিল মাত্র কয়েক সপ্তাহের জন্য। এ বছর গত দুই মাসে দেশে ডিমের দাম বেশ কয়েক দফা বেড়েছে। চলতি মাসের শেষ দুই সপ্তাহ দাম বৃদ্ধির হার ছিল সবচেয়ে বেশি। খুচরা দোকানে এখন ডিম কিনতে ডজনপ্রতি গুনতে হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা। আর বাজারে শুধু ডিম বিক্রি করেন এমন পাইকারি ব্যবসায়ীর কাছে প্রতি ডজন ডিম ১০৫ থেকে ১১০ টাকায় কেনা যাচ্ছে। তবে কোরবানির পর থেকে কখনো পণ্যটির দাম ডজনপ্রতি ৯৫ টাকার নিচে নামেনি। কোরবানির আগে পাওয়া যেত ৭০ টাকায়।
কেন ডিমের এমন হাল? জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প সমন্বয়ক কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, বিগত সময়ে দীর্ঘদিন ডিমের দাম না পেয়ে লোকসানে অনেকেই খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। এ ছাড়া চালু খামারগুলোতে এ বছর এইচ৯এন১ নামক ভাইরাসের সংক্রমণে ডিমের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। সব মিলিয়ে এ বছর ডিমের উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে। এ কারণে ভোক্তাদের বেশি দামে ডিম কিনতে হচ্ছে।
একদিকে ঘাটতি অন্যদিকে অতীতের তুলনায় এ পণ্যের প্রচুর চাহিদা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ৮ বছরে দেশে ডিমের ভোগ বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। কারণ ২০১০ সালে দেশের মানুষ মাথাপিছু প্রতিদিন গড়ে ৭ দশমিক ২ গ্রাম ডিম খেত, যা এখন বেড়ে হয়েছে ১৩ দশমিক ৫৮ গ্রাম। সেটা মাছ বা মাংসের তুলনায় বেশি। কারণ একই সময় ব্যবধানে গরুর মাংসের ভোগ ১০ শতাংশ এবং মাছের ২৬ শতাংশ হারে বেড়েছে।
বর্তমানে ডিমের বাণিজ্যিক উৎপাদন হচ্ছে দৈনিক প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ পিস। আর গৃহপালিত মুরগি, হাঁস ও কোয়েল পাখির ডিম হিসেবে নিলে তা দৈনিক ৪ কোটি ৭১ লাখের ওপরে দাঁড়াবে। যদিও তথ্য বলছে, সারা বছরে দেশে চাহিদার তুলনায় ২০০ কোটি ৮৫ লাখ পিস ডিমের ঘাটতি রয়েছে। এরপরে এ বছর ৩০ শতাংশ হারে উৎপাদন কমেছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
দেশে ডিমের দাম বাড়ার প্রভাব উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মধ্যে খুব বেশি লক্ষ করা না গেলেও দরিদ্র মানুষরা এতে বেশ বিপাকে পড়ে। কারণ উচ্চমূল্যের কারণে তারা আমিষের ঘাটতি পূরণে মাছ-মাংসের থেকে বেশি ভরসা করে ডিমে। কিন্তু ক্রমাগত পণ্যটির দাম বেড়ে যাওয়ায় সেটি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক ড. খালেদা ইসলাম বলেন, দরিদ্র জনগোষ্ঠী সর্বদা দামের বিষয়টি মাথায় রেখে খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলে। হঠাৎ ডিমের এ অস্বাভাবিক দাম তাদের আমিষের চাহিদা পূরণে বড় বাধা। কারণ বিকল্প আমিষ ব্যয়বহুল হওয়ায় সেসব গ্রহণের সক্ষমতা তাদের নেই। ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের বাজার পর্যবেক্ষণ করা দরকার বলে মনে করেন এই পুষ্টিবিদ।
এদিকে ডিমের দাম কবে নাগাদ কমতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ডিম উৎপাদন সমিতির সভাপতি তাহের আহম্মেদ সিদ্দিকী বলেন, নতুন খামারের ডিম আসতে স্বাভাবিকভাবে ছয় মাস সময় লাগে। এর মধ্যে দুমাস পেরিয়েছে। ফলে শিগগিরই ডিমের দাম কমার সম্ভাবনা নেই।