বেসিস স্টুডেন্টস ফোরাম ও বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের সহায়তায় আয়োজিত নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ৯টি শহর (ঢাকা, চট্টগ্রাম সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, রংপুর, ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লা) থেকে আসা ২ হাজার প্রকল্প থেকে বাছাই করে সেরা ৪০টি প্রকল্পকে বাছাই করা হয়েছিল নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জের জন্য।
সেই প্রকল্পগুলো নিয়ে চলতি বছরের ১৯-২০ অক্টোবর ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশে টানা ৩৬ ঘণ্টার হ্যাকাথন অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে শীর্ষ ৮টি প্রকল্পকে নাসার চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়। আর মনোনয়নপ্রাপ্ত আটটি প্রকল্প থেকে প্রথমবারের মতো দুটি ক্যাটাগরির শীর্ষ চারে জায়গা করে নিল বাংলাদেশ।
আগের বার পিপলস চয়েস অ্যাওয়ার্ডে শীর্ষ দশে জায়গা করে নিলেও, এই প্রথমবারের মতো বিশ্বের ৭৯টি দেশের প্রায় ২ হাজার ৭২৯টি দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জের মূল ২টি ক্যাটাগরির শীর্ষ চারে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। গতকাল শনিবার ছয়টি ক্যাটাগরিতে শীর্ষ ২৫টি দলের নাম ঘোষণা করেছে নাসা, যার মধ্যে দুটি ক্যাটাগরির সেরা চারে বাংলাদেশের দল দুটির নাম উঠে আসে।
বেস্ট ইউজ অব ডেটা ক্যাটাগরিতে ‘লুনার ভি আর প্রজেক্ট’ নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া, কুয়ালালামপুর আর জাপানের সঙ্গে শীর্ষে উঠে এসেছে সিলেট থেকে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া দল ‘টিম অলিক’। আর বেস্ট ইউজ অব হার্ডওয়্যার ক্যাটাগরিতে মঙ্গল গ্রহে বেঁচে থাকার জন্য সহায়ক আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া আর তাইপের সঙ্গে শীর্ষ চারে উঠে এসেছে ঢাকা থেকে রানার্স-আপ হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া টিম ‘প্ল্যানেট কিট’।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিটি ক্যাটাগরির চ্যাম্পিয়নের নাম ঘোষণা করা হবে। ছয়টি ক্যাটাগরির ছয়টি চ্যাম্পিয়ন দল নাসায় যাওয়ার এবং শিক্ষানবিস হিসেবে কিছুদিন কাজ করার সুযোগ পাবে।
এ অর্জন সম্পর্কে বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, এ বছর আমাদের লক্ষ্যই ছিল গত তিন আসরের তুলনা ভালো করার। প্রথমবারের মতো প্রধান ছয়টি ক্যাটাগরির মধ্যে দুটি ক্যাটাগরির শীর্ষ চারে স্থান করে নেওয়া নিঃসন্দেহে বড় অর্জন। আমরা বেসিস থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে যাত্রা অব্যাহত রেখেছি, এ অর্জন আমাদের প্রচেষ্টার পথে আরেকটি বড় মাইলফলক। আমি বাংলাদেশের নাম বিশ্ব দরবারে আরো উঁচুতে আসীন করার জন্যে ‘টিম অলিক’ ও ‘টিম প্ল্যানেট কিটকে’ অভিনন্দন জানাচ্ছি।
এক নজরে শীর্ষস্থান অর্জনকারী দুটি দল
টিম অলিক
টিম অলিকের প্রজেক্ট সম্পর্কে দলটির প্রধান আবু সাকিব মাহদি বলেন, ‘লুনার ভি আর’ প্রজেক্টটি মূলত একটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি অ্যাপ্লিকেশন যার মাধ্যমে ব্যবহারকারী চাঁদে ভ্রমণের একটি অভিজ্ঞতা পাবেন। আমরা নাসা প্রদত্ত বিভিন্ন রিসোর্স থেকে থ্রিডি মডেল ও তথ্য সংগ্রহ করে, নাসা আপোলো ১১ মিশনের ল্যান্ডিং এরিয়া ভ্রমণ, চাঁদ থেকে সূর্যগ্রহণ দেখা এবং চাঁদকে একটি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আবর্তন করা এই তিনটি ভিন্ন পরিবেশকে ভার্চুয়ালভাবে তৈরি করেছি। অ্যাপ্লিকেশনটির ব্যবহারকারী, লুনা নামের একজন ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্টের সহায়তায় আমাদের তৈরি ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে চলাফেরা এবং প্রতিক্রিয়া করতে পারবেন। স্বল্প খরচে সকল পরিসরে মহাজাগতিক এক্সপ্লোরেশনের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য।
প্ল্যানেট কিট
ঢাকা বিভাগের রানার আপ ‘প্ল্যানেট কিট’ হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্র্যাকের শিক্ষার্থীদের একটি গবেষণা দল। এ দলের প্রধান রাজিন বিন ইশা জানান, আমাদের দলটিতে সফটওয়্যার, ইলেকট্রনিকস, মাইক্রোবায়োলজি, ত্রিমাত্রিক ডিজাইনিং (থ্রিডি), ভিডিও এডিটিং বিষয়ে দক্ষ চারজন সদস্য রয়েছে যারা কয়েক বছর ধরে মহাকাশ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করে আসছে। সম্প্রতি আমরা ইউআরসি নামক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। এ ছাড়া ব্র্যাক অন্বেষার উপগ্রহ নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ ল্যাবের সঙ্গেও বিভিন্ন কাজে যুক্ত ছিলাম। তিনি আরো বলেন, আমাদের দলের সদস্যদের মধ্যে একটি সমন্বয় রয়েছে। যার ফলে আমরা যেকোনো সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে পারি। এবার আমরা একটি পোর্টেবল ডিভাইস ‘প্ল্যানেট কিট’ তৈরি করেছি যা মঙ্গল গ্রহে বেঁচে থাকার জন্য সহায়তা করবে। আমরা এবার এ প্রকল্পটি নাসা স্পেস অ্যাপ চ্যালেঞ্জে অংশ নিয়েছি। মঙ্গলে উপনিবেশ স্থাপনের সময়বাস্থান অনুসন্ধানের সময় মানুষ বিষাক্ত পরিবেশের মুখোমুখি হতে পারে, অক্সিডাইজ গ্রাউন্ডে খাদ্য উৎপাদন করতে হতে পারে, পানির অভাব, আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত বিপজ্জনক এক্সপোজার, ভ্রমণের সময় দিক হারিয়ে যাওয়া, জৈব পদার্থের অস্তিত্ব শনাক্তকরণ, একাধিক মিশনের জন্য বড় সরঞ্জাম ইত্যাদি। আমাদের লক্ষ্য একটি পোর্টেবল ডিভাইস নির্মাণ করা যা এ সমস্যার একক সমাধান করতে পারে।
প্ল্যানেট কিট পরিবেশের ডাটা প্রদান, প্রাথমিক স্তরের রাসায়নিক পরীক্ষা, জরুরি সতর্কতা এবং বিপত্তি থেকে সহায়তা, মাটির গঠন মূল্যায়ন এবং ক্ষুদ্র পরিসীমায় চাষ, পানীয়যোগ্য পানি সংগ্রহ, পথ পরিকল্পনা, থ্রিডি ভার্চুয়ালাইজেশন ইত্যাদি কাজে সাহায্য করবে। এই ডিভাইসটি নিকট ভবিষ্যতে ঘন ঘন মহাকাশ যাত্রা, স্থান ভ্রমণের খরচ হ্রাস, মূল্যবান গবেষণা তথ্য সংরক্ষণ, এমনকি পৃথিবীতে বিভিন্ন গবেষণার কাজে সাহায্য করবে। এ প্রোটোটাইপ পোর্টেবল ডিভাইসের মধ্যে রয়েছে সেন্সরবক্স, ড্রিলিং মডিউল, পানি পরিস্রাবণ যন্ত্র, প্রাথমিক স্তরের পরীক্ষাগার সরঞ্জাম, স্পেকট্রোফোটো মিটার, স্ক্রিনে ডাটা ডিসপ্লের জন্য নিজস্ব সফটওয়্যার, ডিজিটাল মাইক্রোস্কোপ, ক্যামেরা, নমুনা সংগ্রহের জন্য ড্রিল, জরুরি জল পরিশোধন যন্ত্র, জরুরি অক্সিজেন ব্যাকআপ, অফলাইন মানচিত্র, অফলাইন ট্র্যাক রেকর্ডিং, একটি কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়াজাতকরণ ইউনিট, ব্যাটারি এবং সৌর প্যানেল। এ সেন্সর বক্সে বিভিন্ন গ্যাস ডিটেক্টর রয়েছে যার মধ্যে আছে কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন, আর্গন এবং বায়ুর আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ও চাপ। মাটি পরীক্ষা এবং জৈব স্বাক্ষর শনাক্ত করার জন্য এটিতে আছে মাটির আর্দ্রতা, মাটির তাপমাত্রা, মাটির পিএইচ মাপার জন্য একটি প্রব। আরো আছে বিকিরণ সেন্সর, আলোর তীব্রতা মাপার সেন্সর, মাইক্রোস্কোপিক মূল্যায়ন, স্পেকট্রোফটো মিটার আর এন্ডোস্কোপিক ক্যামেরা।
এ যন্ত্রটি সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, আমাদের এ ডিভাইস গ্রহ অনুসন্ধান এবং জীবন সহজ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। ডিভাইসটি এমনভাবে তৈরি করেছি যাতে এটি যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে। তবে এই লক্ষ্য অর্জন এবং উন্নয়নের জন্য আমাদের আরো উন্নত পরীক্ষাগার প্রয়োজন। এ ছাড়া পণ্য পরীক্ষার জন্য আমাদের একটি সিমুলেশন ল্যাব প্রয়োজন। আমাদের যন্ত্রটি সৌরজগতের বাইরে অন্বেষণ করার সুযোগ করে দেবে এবং স্পেসে সরাসরি মানব সংযোগ তৈরি করবে যা পূর্বে একটি নিছক অনুমান ছিল। মানব প্রজাতির বেঁচে থাকার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমদের মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে যাচ্ছে যা দূরবর্তী গ্রহগুলোয় পাওয়া সম্ভব। বিভিন্ন ইন্টারগ্যালাক্টিক পরিবর্তন এবং ঘটনা আমাদের গ্রহের ভাগ্য সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বহন করে। এজন্য এই কিট মানবজাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।