রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মতো এটি সাধারণ দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত রোগ, তবে এটি প্রধানত মেরুদণ্ড ও কোমরের দুই দিকের অস্থিসন্ধিকে (স্যাক্রোইলিয়াক জয়েন্ট) আক্রান্ত করে। এ রোগের বৈশিষ্ট্য হলো পিঠ ব্যথা ও শক্ত হয়ে যাওয়া। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হিপ এবং কাঁধ আক্রান্ত হতে পারে। খুব বিরল ক্ষেত্রে প্রান্তিক অস্থিসন্ধিগুলো আক্রান্ত হয়। জরিপে দেখা গেছে, পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় এটি ০.১ থেকে ০.২ শতাংশ লোকের হয়, সবচেয়ে কম হয় জাপানি ও আফ্রিকার লোকজনের। মহিলাদের তুলনায় পুরুষরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হন (অনুপাত হলো ২:১ থেকে ১০:১)। সচরাচর ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগের একটি প্রধান কারণ বংশগত এবং এর সঙ্গে জেনেটিক মার্কার এইচএলএ-বি২৭ এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
রোগের কারণ : এ রোগের সঠিক কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি, তবে বংশানুগতিক কারণের সঙ্গে এটি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে এ রোগ বেশি দেখা দেয়। যারা এ রোগে আক্রান্ত হন, তাদের প্রায় সবাই জেনেটিক মার্কার বা বংশগত নির্দেশক এইচএলএ-বি২৭ বহন করেন। কিন্তু যারা এই নির্দেশক বহন করেন তারা সবাই এই বাত রোগে আক্রান্ত হন না। ৯৫ শতাংশের বেশি ককেশীয় রোগীদের শরীরে এইচএলএ-বি২৭ উপস্থিত থাকে এবং এদের অর্ধেকেরই খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যে হয়।
কেউ কেউ সন্দেহ করেন, মেরুদণ্ডে এক ধরনের প্রদাহ হলে এ রোগ হয়। যেহেতু কারো কারো মূত্রথলি, মূত্রনালি ও চোখে প্রদাহ হয়, সেজন্য প্রদাহকে এ রোগের অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়। সংক্রামক উস্কানিদাতা হিসেবে কিছু গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্লেবসিয়েলাকে দায়ী করা হয়।
উপসর্গ : রোগী সাধারণত সকালে পিঠ শক্ত হওয়া ও পিঠ ব্যথার অভিযোগ নিয়ে আসেন। ব্যথা শুরু হয় কোমরের দুদিকের অস্থিসন্ধি বা স্যাক্রোইলিয়াক জয়েন্টে এবং ধীরে ধীরে তা সারা পিঠে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ব্যথা হিপজয়েন্ট (ঊরু অস্থিসংযোগ স্থল) ও নিতম্বে ছড়িয়ে পড়ে। রোগীর জ্বর হতে পারে এবং বুকের প্রসারণ কমে যেতে থাকে। অল্পবয়সী রোগীর বুকের প্রসারণ কমপক্ষে সাত সেন্টিমিটার কমে যায়। ক্রমেই মেরুদণ্ড শক্ত হয়ে পড়ে, মেরুদণ্ডে বাঁক ধরতে শুরু করে। রোগী সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। অনেক রোগী সামনে ও উপরের দিকে তাকাতে পারেন না। আশপাশের কাউকে দেখতে হলে শরীরটাকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেখতে হয়। ধীরে ধীরে হিপজয়েন্ট, হাঁটু এমনকি কনুইও শক্ত হয়ে যায়। রোগীর হাঁটতে সমস্যা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রান্তিক অস্থিসন্ধি যেমন গোড়ালির গাঁটে ব্যথা ও সামান্য ফোলাসহ রোগের সূত্রপাত হয় কিংবা হিপে ব্যথা ও শক্ত হওয়ার মাধ্যমে রোগ শুরু হয়। শিগগিরই ব্যথা পিঠে চলে যায়।
অনেক রোগীর শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। ক্ষুধামন্দা হয় এবং রোগী শারীরিকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েন।
কোনো কোনো রোগীর মেরুদণ্ড ধনুকের মতো বেঁকে যায় এবং এর ফলে রোগী সোজা হয়ে শুতে পারেন না, তাকে পাশ ফিরে শুতে হয়। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রোগীর প্রান্তিক অস্থিসন্ধিগুলো (সাধারণত কাঁধ, হিপ এবং হাঁটু) সম্পৃক্ত হয়; এগুলোতে ইনফ্লামেটরি আর্থ্রাইটিসের মতো উপসর্গ দেখা দেয়, যেমন ফুলে যাওয়া, চাপ দিলে ব্যথা অনুভূত হওয়া, পানি জমা এবং নড়াচড়া করার ক্ষমতা লোপ পাওয়া। বড় বড় অস্থিসন্ধি সন্নিবিষ্ট লিগামেন্ট ও টেনডনে কিংবা গোড়ালির নিচে চাপ দিলে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। কিছু কিছু রোগীর সাধারণ অবসন্নতা থাকে এবং ওজন কমে যায়। প্রায় ২৫ শতাংশ রোগীর চোখে প্রদাহ হয়।
রোগ নির্ণয় : যেসব রোগীর মেরুদণ্ড শক্ত ভাব বা অনমনীয়তা থাকে এবং বৈশিষ্ট্যসূচক বিকলাঙ্গতা থাকে, সেসব রোগীর রোগ নির্ণয় সহজ; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় কিংবা রোগী অস্বাভাবিক ধরনের উপসর্গ নিয়ে এলে রোগ নির্ণয় কঠিন হয়ে পড়ে। প্রায় ১০ শতাংশের বেশি রোগীর রোগ শুরু হয় অপ্রতিসম ইনফ্লামেটরি আর্থ্রাইটিসের উপসর্গ দিয়ে- সাধারণত হিপ, হাঁটু বা গোড়ালির গাঁটের— এটা পিঠ ব্যথা দেখা দেওয়ার আগে কয়েক বছর থাকতে পারে। মহিলারা সবচেয়ে বেশি বৈশিষ্ট্যহীন উপসর্গ নিয়ে আসেন, এদের স্যাক্রোইলিয়াক জয়েন্টে খুব কম পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের অ্যানকাইলোজিং স্পনডিলাইটিসের ইতিহাস থাকলে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সেটি একটি জোরালো ইঙ্গিত বহন করে।
অল্পবয়স্ক রোগীদের কোমর ব্যথা সাধারণত অনেক কারণে হতে পারে। যেমন- মাংসপেশির টান, ফ্যাসেট জয়েন্টে সমস্যা বা কশেরুকা সরে যাওয়া। অ্যানকাইলোজিং স্পনডিলাইটিস থেকে এসব অবস্থা আলাদা করে চেনার অনেক উপায় রয়েছে। এসব অবস্থার সঙ্গে নির্দিষ্ট শারীরিক কাজকর্মের সম্পর্ক রয়েছে, শক্তভাব খুব কম প্রসিদ্ধ। ব্যথা নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে। প্রান্তিক অস্থিসন্ধিগুলো স্বাভাবিক থাকে। বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে কোমর ব্যথার একটি কারণ হলো, দুই কশেরুকার মাঝে স্পার তৈরি হওয়া। যদিও এটাকে অ্যানকাইলোজিং স্পনডিলাইটিস বলে প্রতীয়মান হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটা কোনো প্রদাহজনিত রোগ নয়, মেরুদণ্ডে ব্যথা ও শক্তভাব খুবই কম হয়, স্যাক্রোইলিয়াক জয়েন্টে কোনো ক্ষয় থাকে না এবং ইএসআর স্বাভাবিক থাকে।
ওষুধ : অ্যানকাইলোজিং স্পনডিলাইটিসের চিকিৎসার মধ্যে ওষুধ গ্রহণের বিষয়টি রয়েছে। কিন্তু ওষুধ রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণীর। আপনার ক্ষেত্রে একটি আরেকটির চেয়ে আরো ভালো কাজ করতে পারে। যদি আপনার চিকিৎসক আপনাকে একটি ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন, আপনি নিশ্চিত হয়ে নেবেন ওষুধটি কোন শ্রেণির (উদাহরণস্বরূপ, নন-স্টেরয়ডাল অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি ড্রাগ, টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টর ইনহিবিটর), কীভাবে সেটা কাজ করে এবং কেন সেটা আপনার জন্য বাছাই করা হলো।
চিকিৎসাপদ্ধতি : প্রথমত এ রোগ সম্পর্কে রোগীর পূর্ণ ধারণা থাকা উচিত। যেহেতু এ রোগের প্রথম উপসর্গ ব্যথা এবং এই ব্যথা কোমর থেকে শুরু হয়ে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, ব্যথা এত তীব্র হয় যে ব্যথানাশক ওষুধ দিতে হয়। অনেক সময় শুধু ব্যথানাশক ট্যাবলেট নয়, ইনজেকশনেরও প্রয়োজন হয়। ব্যথানাশক ওষুধের পাশাপাশি গরম সেঁক দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। ফিজিও থেরাপি, বিশেষ করে কোমরের ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ব্যায়ামের মাধ্যমে বেশ উপকার পাওয়া যায়। যেহেতু এ রোগে অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়, তাই ব্যায়াম অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিকে শিথিল করে। রোগী সাবলীলভাবে নড়াচড়া করতে পারে। অধিকাংশ রোগী সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে স্পাইনাল ব্রেস ব্যবহার করতে দেয়া হয়। রোগ দীর্ঘস্থায়ী হলে অস্থিসন্ধি এত শক্ত হয়ে যায় যে, বিভিন্ন ধরনের অপারেশনের প্রয়োজন হয়। সুতরাং এক কথায় অ্যানকাইলোজিং স্পনডিলাইটিসের চিকিৎসা পদ্ধতি হচ্ছে—
— মেডিকেল চিকিৎসা, ফিজিও থেরাপি, স্পাইনাল সাপোর্ট, সার্জারি
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমা বিভাগ
ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল