মেহেরপুর মুজিবনগর মোনাখালী গ্রাম, জেলা জুড়ে পরিচিত লাভ করেছে মাল্টা গ্রাম হিসাবে। গ্রামের দক্ষিণে এগুলেই পিচ রাস্তার ধারে চোখে পড়বে সারি সারি বেশ কয়েকটি মাল্টা বাগান। ওই সব বাগানে থোকায় থোকায় ঝুলছে রসালো মাল্টা ফল। বাগানে প্রায় সকল গাছেই সবুজ ও হলুদ মাল্টা ঝুলছে। বাগানের শ্রমিকরা কেউ মাল্টা পাড়ছেন, কেউ পরিচর্যা করছেন, আবার কেউ কেউ মাল্টা কেনা বেচার কাজ সারছেন। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যাবে। পথচারিরা ওই সড়ক দিয়ে যেতে আসতে মাল্টা চাষে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন।
গ্রামের কৃষক ইসমাইল হোসেন। দীর্ঘ ৬ বছর প্রবাস জীবন শেষে ২০০৬ সালে দেশে ফেরেন । অনান্য পেশায় না গিয়ে শুরু করেন চাষাবাদ। প্রথমে সবজিসহ নানামূখি চাষবাস করলেও সংসারের ব্যয় মেটাতে হিমসীম খেতে হচ্ছিল তাকে। বীজ, সার, তেল শ্রমিকের খরচ মেটাতে গিয়ে লাভের বদলে লোকসান গুণতে হচ্ছিল। ভেবে চিন্তে ২০১৪ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া বারি মাল্টা-১ এর ৫০ টি চারা তার ১২ কাঠা জমির পটল ক্ষেতের মধ্যে রোপন করেন। পরিচর্যার দেড় বছরের মাথায় গাছে ফুল আসতে শুরু করে। দুই বছরের মাথায় গাছে ফল ধরে। ওই বছরে ৬০ হাজার টাকার মাল্টা বিক্রি করেন তিনি। পরে গ্রাপ্টিং পদ্ধতিতে চারা তৈরি করে তিন লাখ টাকার চারা বিক্রি করেন। লাভজনক হওয়ায় বর্তমানে তার বাগান বেড়ে সাড়ে ১৫ বিঘায় উন্নীত হয়েছে। এখন তার বাগানের গাছ গুলোর বয়স চার থেকে সাত বছর। বর্তমানে তার সকল গাছ ফল ফুলে ভরে আছে। প্রায় ১২ বিঘা বাগানেই রসালো মাল্টা ধরছে। এই সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকেই মাল্টা বিক্রি শুরু হয়েছে। সাড়ে সাত লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করা হয়ে গেছে। আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত অন্তত ৫০ লাখ টাকার মাল্টা ফল বিক্রির আশা করছেন তিনি। খরচ বাদে কমপক্ষে ৩০ লাখ টাকা ঘরে আসবে বলে আশা করছেন ইসমাইল হোসেন। ঢাকাসহ বাইরের জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে বাগান থেকে মাল্টা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে প্রকার ভেদে ৮০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে ফল। ক্রেতারা আগ্রহ ভরে অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখছেন বাগান মালিককে। যেন ফল পাকার সাথে সাথে অগ্রিম টাকা দেওয়া ক্রেতাকে আগে সরবরাহ করা হয় সেই আশায়। শুধু মাল্টাই নয় কলম করে প্রতিটি চারা ১৫০টাকা থেকে ২৫০ টাকা দরে বিক্রি করে অন্তত ৫ লক্ষ টাকার চারাও বিক্রি করা সম্ভব হবে বলে দাবি ইসমাইল হোসেনের। প্রচলিত চাষের পরিবর্তে অপ্রচলিত মাল্টা ফল চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুড়িয়ে জয়ী তিনি। এখন তিনি নিজেকে সফল চাষী হিসাবে দাবী করে নিজেই খুশি।
কৃষক ইসমাইল হোসেন বলেন, আমি জেলায় প্রথম মাল্টা চাষ শুরু করলেও এখন এ জেলায় অনেকেই মাল্টা চাষে ঝুঁকে পড়ছেন। প্রথম দিকে চারার সমস্য হলেও এখন মেহেরপুরেই চারা উৎপাদন হচ্ছে। আমরা কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে গ্রাফটিং ও গুটিকলম পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করছি। এবছর চারা বিক্রি করেই বেশ ভাল লাভবান হয়েছি। তবে এবার মাল্টা চাষে ভিন্নতা এনেছি। এখন মিশ্রভাবে মাল্টার সাথে ভিয়েতনামী নারকেল (যাকে খাট জাতের নারকেল বলে) চাষ শুরু করেছি। আশা করছি তাতেও সফলতা আসবে। বর্তমানে মেহেরপুরের আশপাশ জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বাগান করার জন্য চারা নিতে আসছেন। চাহিদা অনুযায়ী চারা না পেয়ে অর্ডার দিয়ে যাচ্ছেন। একই উপজেলার মহাজনপুর গ্রামের চাষি মাহাবুল হক বলেন, অধিক লাভবান হওয়ায় অনেক বেকার যুবক এগিয়ে আসছেন মাল্টা চাষে। কারণ মাল্টার জমিতে দুই বছর অন্য ফসলের আবাদ করা সম্ভব। ঐ ফসলের লাভ দিয়ে মাল্টা বাগান তৈরি হয়ে যাচ্ছে। ঘর থেকে টাকা খরচ করা লাগছে না। অধিক লাভ দেখে তাদের সাথে চারা সংগ্রহ করে জেলায় এখন নতুন করে অন্তত ১শ বিঘা জমিতে মাল্টার বাগান হয়ে গেছে। ইসমাইলের বাগান দেখে অনুপ্রণিত হয়ে জেলার শফিউল ইসলাম, খাদেমুল ইসলাম, মুকুল হোসেন, হাসেম আলী, আব্দুল কাদের মাল্টা চাষে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন। তাদের দেখা দেখি এখন সারা জেলায় লাভ জনক এ চাষ ছড়িয়ে যাচ্ছে।
আমদানি নির্ভর ফল মাল্টা। এতদিন এ ফলটি সিলেট জেলায় চাষ হলেও, বিগত চার বছর ধরে মাল্টা চাষ করে ব্যাপক সফলতার মুখ দেখছেন মেহেরপুরের কৃষকও। ক্রমান্বয়ে প্রতি বছর বাড়ছে মাল্টার বাগান। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বারি মাল্টা-১ চাষের জন্য উপযোগী মেহেরপুরের মাটি। মাল্টা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে রসালো এ ফলটি।
মাল্টা বাগান লাভজনক ও সফলতার সাথে মেহেরপুরে চাষ হওয়ায় কৃষি বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক চন্ডিদাস, মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. স্বপন কুমার খাঁ, জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ মুনসুর আলম খাঁন, পুলিশ সুপার রাফিউল আলমের মত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বেশ কিছু কর্মকর্তা মাল্টা বাগান পরিদর্শণ করে বাগান মালিকদের উৎসাহ দিয়েছেন।
মেহেরপুর কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডঃ স্বপন কুমার খাঁ বলেন, সিলেটের সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্র উদ্ভাবন করেছে বারি মাল্টা-১। এটি বালাদেশের সব এলাকায় চাষ করা সম্ভব হলেও মেহেরপুরের মাটি মাল্টা চাষের জন্য খুবই উপযোগি। কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে পারলে আমদানি নয়, মাল্টা চাষ করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করাও সম্ভব। এখন মেহেরপুরে যারা মাল্টা চাষ করেছেন তারা ব্যাপক লাভবান হচ্ছেন। যে কোন ধরনের চাষের জন্য মেহেরপুরের মাটি অন্যন্য। ফসল ও সবজি বাগান সহ সকল ধরনের চাষই এখানে খুব ভাল হয়। মাল্টা চাষও ভাল হচ্ছে। কৃষি বিভাগের পরামর্শ সব সময় চাষীদের জন্য অব্যহত থাকবে।