থমকে আছে হত্যা মামলা

প্রতীকী ছবি

জাতীয়

থমকে আছে হত্যা মামলা

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ৬ এপ্রিল, ২০২২

রহস্যের জাল থেকে বেরুতে পারছে না আলোচিত বেশ কিছু হত্যা মামলা। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার কারণে বিচার পাওয়ার আশাই ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে। আবার অনেকে ক্ষীণ আশা এই ভেবে যে, হয়তো একদিন প্রিয়জনের মৃত্যুর কারণটি জানতে পারবেন। আলোচনার ঝড় তোলা এমন হত্যাকাণ্ডের তালিকায় আছে পুলিশ, চিকিৎসক বা সাংবাদিক, তেমনি আছে একেবারেই সাধারণ মানুষ। তবে কেন, কি অপরাধে বা কারা তাদের খুন করলো সেই রহস্য জানা যাচ্ছে না যুগ পেরিয়ে গেলেও।

এরমধ্যে সাত বছরেও জানা যায়নি চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের শিক্ষক অঞ্জলী দেবীর খুনি কারা। আর ৮ বছরে কিনারা হয়নি সংগীতজ্ঞ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাই আহমেদ মিরাজ খুনের রহস্য। রাজধানীর পল্লবীতে ছোট্ট শিশুর সামনে জোড়া খুনের রহস্য ভেদ করা যায়নি ৭ বছরেও। অর্ধযুগেও অগ্রগতি হয়নি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনু হত্যার মামলার। আট বছরেও কূল-কিনারা হয়নি  মেধাবী স্কুলছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ড মামলাটিরও। প্রায় এক বছর হতে চললো চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান হত্যাকাণ্ডের কোনো কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। চার্জশিট তো দূরের কথা ১০ বছরে তদন্তই শেষ হয়নি বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি দম্পতি হত্যা মামলার। একইভাবে কিনারা হয়নি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফজলুল করিম এবং ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ সদস্য ইলিয়াসউদ্দিন মোল্লাহর ব্যক্তিগত সহকারী আমির হোসেন হত্যা মামলারও। 

চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অঞ্জলী দেবীর খুনিদের খুঁজে বের করতে  এ পর্যন্ত পুলিশের ৯ কর্মকর্তা মামলাটির তদন্ত করেছেন। কিন্তু রহস্য দুর্ভেদ্যই থেকে গেছে। গোয়েন্দা পুলিশের পর মামলাটি এখন তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে নগরের চকবাজারের উর্দু গলিতে দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন হন অঞ্জলী দেবী। এ ঘটনায় তার স্বামী চিকিৎসক রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী বাদী হয়ে ওই রাতে পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয় যুবকদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। কিন্তু এত দিনেও খুনের রহস্য উদ্‌ঘাটিত না হওয়ায় বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছে অঞ্জলীর পরিবার।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্র জানায়, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। হত্যাকাণ্ডে চার যুবক অংশ নেন। তাদের প্রত্যেকের কাঁধে স্কুলব্যাগ ছিল। ওই ব্যাগে করে তারা রামদা নিয়ে আসেন। অঞ্জলী দেবীকে কুপিয়ে রামদা ব্যাগের ভেতর নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যান। হত্যাকারীরা ছিনতাইকারী হলে অঞ্জলীর মুঠোফোন ও টাকা কেড়ে নিতেন। কিন্তু তার কাছ থেকে কিছুই নেননি তারা। পরিবারের সদস্যরাও কারো সঙ্গে বিরোধ বা কারণ জানাতে পারেননি। এমনকি কাউকে সন্দেহও করেননি তারা। স্ত্রীকে হারিয়ে ঘটনার পর শহরের বাসা ছেড়ে দিয়ে দুই চিকিৎসক মেয়েকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি হাটহাজারী চলে যান রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী। তিনি মুঠোফোনে বলেন, অন্তত স্ত্রীর খুনের কারণটা জেনে যাতে মরতে পারি। সাত বছরেও খুনের রহস্যের কিছুই হলো না, কীভাবে বিচারে আশা রাখি!

২০১৪ সালের মার্চ মাসে রাজধানীতে সংগীতজ্ঞ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাই আহমেদ মিরাজ খুন হন। প্রায় ৮ বছরেও আলোচিত ওই হত্যা মামলার কোনো কিনারা হয়নি। একইভাবে কিনারা হয়নি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফজলুল করিম এবং ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ সদস্য ইলিয়াসউদ্দিন মোল্লাহর ব্যক্তিগত সহকারী আমির হোসেন হত্যা মামলারও। এসব মামলায় কেউ গ্রেপ্তারও হয়নি। তদন্তেও তেমন অগ্রগতি নেই। ফজলুল করিমকে ২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট সকালে দুর্বৃত্তরা রামপুরার বাসায় ঢুকে গুলি করে হত্যা করে। একই বছরের ৯ জুলাই রাতে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের পূর্ব পাশের সড়কে চলন্ত মাইক্রোবাস থেকে ফেলে দিয়ে আমির হোসেনকে হত্যা করা হয়। খিলক্ষেতে রেললাইনের পাশ থেকে ২০১৩ সালের ৮ মার্চ গভীর রাতে মিরাজের লাশ উদ্ধার করা হয়।

আট বছরেও কূল-কিনারা হয়নি মেধাবী স্কুলছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ড মামলাটির। তদন্ত চলাকালে গ্রেপ্তার দুই আসামির ভিন্ন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আর খসড়া অভিযোগপত্রের ঘেরাটোপেই আটকে আছে মামলাটি। মামলার বাদী রফিউর রাব্বি দাবি করে আসছেন ওসমান পরিবারের ছেলে আজমেরী ওসমানের অফিসে নির্যাতন চালিয়ে, পিটিয়ে ও গলাটিপে শ্বাসরোধ করে ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে। আজমেরী ওসমানের অফিস থেকে র্যাব অভিযান চালিয়ে ‘রক্তমাখা’ একটি প্যান্টও উদ্ধার করে। অভিযোগের আঙুল যার দিকে সেই শামীম ওসমান এমপি জানিয়েছেন, পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে কথা বলা আইনসম্মত নয়। 

অর্ধযুগেও অগ্রগতি হয়নি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী তনু হত্যার মামলার। দীর্ঘ অপেক্ষা করে কোনো সমাধান না পেয়ে বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছে তনুর পরিবার। গণজাগরণ মঞ্চের কুমিল্লার সংগঠক খায়রুল আনাম রায়হান জানান, তনু হত্যাকারীদের বিচারের আশায় আমরা রাজপথে টানা আন্দোলন করেছি। কিন্তু আমরা কোনো বিচার পাইনি। একটি আলোচিত হত্যার শেষ পরিণতি এমন হবে ভাবতেই অবাক লাগে। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় কুমিল্লা সেনানিবাসের একটি বাসায় প্রাইভেট পড়াতে গিয়ে তনু নিখোঁজ হয়। পরে রাতে সেনানিবাসের ভেতরের একটি জঙ্গল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ডিএনএ টেস্টের রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করার পর পুলিশ, ডিবি ও পরে সিআইডি মামলা তদন্ত করেও কোনো কুল-কিনারা পায়নি। সর্বশেষ পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর তনু হত্যা মামলার নথি পিবিআইয়ে হস্তান্তর করা হয়। হত্যার ছয় বছর পার হলেও তদন্ত এখনো চলমান রয়েছে।

প্রায় এক বছর হতে চললো চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান হত্যাকাণ্ডের কোনো কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। মামলার তদন্ত নিয়ে তারা অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে। তবে সাবিরার পরিবার চায়, আরো সময় লাগলেও হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হোক। গত বছরের ৩০ মে সকালে রাজধানীর কলাবাগান প্রথম লেনের তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটের শোবার ঘর থেকে চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান ওরফে লিপির রক্তাক্ত ও দগ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালের কনসালট্যান্ট (সনোলজিস্ট) ছিলেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, সাবিরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, ওই বাড়িতে কেউ এলে তা নিবন্ধন করার ব্যবস্থা ছিল না। সাবিরাকে হত্যা করে খুনিরা চলে গেলেও দরজা ভাঙার আলামত নেই। তাকে গায়ে আগুন ধরিয়েও দেওয়া হয়নি। তোশকে ধরে যাওয়া আগুনে তিনি দগ্ধ হন। এ ছাড়া সাবিরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেই বাড়ির সামনে সিসি ক্যামেরা ছিল না। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সাবিরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেই বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক ও গৃহকর্মী, ভবনের বাসিন্দা ও সাবিরার সহকর্মী স্বজন, পরিচিত জনসহ হত্যাকাণ্ডের আগে-পরে তার মুঠোফোনের কল তালিকাসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত হত্যায় জড়িত কাউকে শনাক্ত করা যায়নি

২০১৫ সালের ১৩ মে রাজধানীর পল্লবীর ২০ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর বাসাটির ষষ্ঠ তলাতেই ঘটেছিল নৃশংস এক জোড়া খুনের ঘটনা। পাঁচ বছওে শিশু সাজিদ বিন জাহিদ সাদের সামনেই হত্যা করা হয়েছিল মা সুইটি আক্তার ও নানা আমিনুল ইসলামকে। দুর্বৃত্তরা তাকেও কুপিয়ে করেছিল রক্তাক্ত। সাদের বয়স তখন ছিল সাড়ে ৫ বছর, এখন সাড়ে ১২। শিশু সাদের মতো পুলিশও বলছে, ওই বাসায় হয়েছিল জোড়া খুন। তবে সাত বছরেও খুনি শনাক্ত করা যায়নি। বাসার ভেতর দু-জনকে নৃশংসভাবে হত্যার রহস্যও হয়নি ভেদ। কোনো কিছু বের করতে না পেরে থানা পুলিশ থেকে ডিবি হয়ে শেষমেষ তদন্ত সংস্থা সিআইডি মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। আদালতে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে সিআইডি বলেছে, ‘হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সত্য, আসামি খুঁজে পাওয়া না যাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। পরে বাদীর নারাজিতে আদালতের নির্দেশে ওই জোড়া খুনের মামলাটি এখন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আবার তদন্ত করছে।’

দেশ-বিদেশে বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি দম্পতি হত্যা মামলার বিচার, চার্জশিট তো দূরের কথা ১০ বছরে তদন্তই শেষ হয়নি। ৮৫ বার সময় নিয়েও তদন্তকারীরা আদালতে প্রতিবেদন দিতে পারেননি। ৮৬ বারের জন্য সময় চেয়েছেন।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি নৃশংসভাবে খুন হন। হত্যাকাণ্ডের সময় বাসায় ছিল তাদের সাড়ে চার বছরের ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘ।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads