দেশের রপ্তানি খাতে সরকারের বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ কিছুটা স্বস্তি দিলেও বাদ সেধেছে বিশ্বব্যাপী কন্টেইনার ও জাহাজ সংকট।
পোশাক খাত থেকে দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৪ ভাগ আসে। তবে মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে অন্যান্য খাতের মতো এই খাতও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। করোনা রোধে লকডাউন জারির কারণে পোশাক কারখানা বন্ধসহ বিদেশি ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ায় বিপাকে পড়েন খাত সংশ্লিষ্টরা।
রপ্তানিকারকরা কন্টেইনার সংকটের মধ্যে এয়ারের (উড়োজাহাজ) মাধ্যমে পোশাক ডেলিভারিতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে শঙ্কা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। কারণ লাভের অংশ চলে যাচ্ছে উড়োজাহাজ ভাড়ায়। তবে এসব সমস্যার মধ্যে পোশাক খাতে দ্রুত স্বস্তি ফিরবে বলে আশা খাত সংশ্লিষ্টদের।
পোশাক খাতের এক উদ্যোক্তা জানান, বিশ্বব্যাপী এখন সংকট তৈরি হয়েছে। এর আগে যে জাহাজে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ২১ দিনে সম্ভব হতো, সেটা এখন ৩৫ থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে। এতে বন্দরে কন্টেইনার আটকে যাচ্ছে, আবার কন্টেইনার খালাস না হওয়ায় জাহাজও একই পরিস্থিতিতে পড়ছে। এতে তীব্র কন্টেইনার ও জাহাজ সংকট তৈরি হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, এ অবস্থায় বিকল্প পদ্ধতিতে (উড়োজাহাজ) পণ্য রপ্তানি করতে হচ্ছে। ক্রেতা আর বাজার ধরে রাখতে বাধ্য হয়ে এভাবে পণ্য সরবরাহ করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন, শ্রমিকের মজুরি আর বিমান ভাড়ায় সব চলে যাচ্ছে। ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে রপ্তানিকারকদের।
একই কথা বলছেন পোশাক খাতের আরো বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা। তারা বলছেন, এভাবে চললে পথে বসার উপক্রম হবে।
বিশ্বব্যাপী জাহাজ, খালি কন্টেইনার সংকটের কারণে পণ্য আমদানির খরচ বেড়েছে। জানুয়ারির শুরুতে ফের জল যাতায়াতের খরচ বাড়তে পারে। শিল্পের কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য বাংলাদেশকে আমদানি করতে হয় জাহাজের মাধ্যমে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে জাহাজ চলাচলের সময়সূচি বিঘ্নিত হয়েছে, সে জট এখনও অব্যাহত। এ কারণে খালি কন্টেইনারের অভাব আমদানি বাণিজ্যকে আরো কঠিন করেছে।
নতুন বছরের শুরু থেকে ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরে নতুন চার্জ কার্যকর করার কথা ঘোষণা করেছে বড় বড় জাহাজ কোম্পানি। বাড়তি এই খরচ শুষ্ক এবং রেফ্রিজারেটেড কন্টেইনার, বিশেষ সরঞ্জাম বহনকারী জাহাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
কন্টেইনার সংকট বিষয়ে বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) ফজলে শামীম এহসান বলেন, কন্টেইনার সংকট নেই। তবে করোনার কারণে শিপমেন্ট হতে দেরি হচ্ছে। যে-কোনো কন্টেইনার এর আগে আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ২১ দিনে ক্লিয়ার হতো, এখন সেটা ৩৫ দিন পযৃন্ত সময় লেগে যায়। এই সময়ের ব্যবধান এখন বিশ্বব্যাপী। সব বন্দরেই একইভাবে দেরি হওয়ায় সাময়িক সংকট তৈরি হচ্ছে।
কন্টেইনার সংকট রপ্তানিতে কোনো প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই সাময়িক সংকটের ভয়ংকর দিক আছে। বায়ার আমার মালের অর্ডার বাতিল করছে, আবার অর্ডার দিচ্ছে, আবার বলছে দ্রুত পাঠাতে। এতে বাই এয়ারে (বিমানে) মাল শিপমেন্ট করতে হয়, মাল দ্রুত গেলেও খরচ বেশি পড়ে। যেটা উদ্যোক্তাকে বহন করতে হচ্ছে, এতে লাভের চেয়ে খরচের অঙ্ক বেশি।
ব্যবসায়ীরা বলেন, পোশাক শিল্পের সঙ্গে নির্মাণ খাতে এর প্রভাব পড়েছে। রড ও ইস্পাত শিল্প ক্র্যাপের ওপর নির্ভরশীল, যা সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর। এর মধ্যে পরিবহন খরচ প্রায় ১০০ ডলার বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডাসহ অন্যান্য রপ্তানিকারক দেশে শিপিং ফি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া খালি কন্টেনাইরের অভাব সংকটকে আরো ঘনীভূত করেছে। চলতি অর্থবছরের বিগত চার মাসে প্রায় ১৭ দশমিক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যেও পণ্য আমদানি করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যে পণ্য আমদানি করেছে, যা বিগত অর্থবছরের থেকে প্রায় ১৩ শতাংশ কম। আবার চট্টগ্রাম বন্দরে সব চার্জসহ এক টন ডালের দাম আগে ৫৭০ ডলার থাকলে এখন তা প্রতিটনে ২০ ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে ফল ব্যবসায়ীরা বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকা ও চীন থেকে ফল আমদানি করে। জাহাজ চলাচলের খরচ বাড়ার কারণে ফলের দামও বৃদ্ধি পাবে।
তারা বলেন, ফি বাড়ার আগে সাড়ে ৮ থেকে ৯ ডলারে ২০ কেজি আপেলের কার্টন পাওয়া যেত, যা এখন ১১ থেকে ১২ ডলারে ঠেকেছে। এর ফলে বাড়তি দামে ক্রেতাদের ফল বিক্রি করতে হচ্ছে। শিগগিরই অবস্থার উন্নতির সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর থেকেই পণ্য পাঠানো থেকে সর্বত্র স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে। খালাসে শারীরিক দূরত্ব মেনে সব কার্যক্রম চলছে বিশ্বব্যাপী। এতে পণ্য খালাস ও জাহাজীকরণে বাড়তি সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই গুণ অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে।
করোনা পূর্ববর্তী সময়ে ২১ দিনে একটি জাহাজ খালাস হলেও পরবর্তীতে তা ৩৫ থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত সময়ের প্রয়োজন পড়ছে। এছাড়া করোনা মহামারির প্রথম দিকে কন্টেইনার জট শুরু হয়েছিল। সে জট এখনো কাটেনি। এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসতে শুরু করেছে। এতেই তৈরি হয়েছে শঙ্কা, পণ্য রপ্তানিতে এখন বিপদে রপ্তানিকারকরা।