হিজড়া-তিন অক্ষরের শব্দটি দুবার না, মনে মনে একবার উচ্চারণ করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রচণ্ড জ্যামে যানবাহনে, কোলাহলপূর্ণ জায়গায় কিংবা অন্যত্র হাততালি দিয়ে হিজড়া দলের দাবি করে অর্থ আদায়ের দৃশ্য এবং যখন তারা তাদের চাহিদামতো অর্থ পান না তখন তাদের ভেতর দেখা যায় নানা অশোভনীয় আচরণ। এদের বেশি দেখা যায় নবজাতকের বাসায়, যেখানে তারা বাচ্চা কোলে নিয়ে অসামান্য অর্থ আদায়ের চেষ্টা করেন। এমনকি অভিভাবকের অর্থ প্রদানের ক্ষমতা না থাকলেও তারা তাদের চাহিদা অটল রাখেন। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতিক্রম দেখা যায়। হিজড়াদের নানারকম দৃষ্টিকটু আচরণের কারণে সাধারণ মানুষ তাদের খারাপ চোখে দেনেখ, এমনকি অনেকে কটাক্ষ করে কথাও বলেন। হিজড়াদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যেমন ঘৃণা, উপহাস এবং তাচ্ছিল্যের দৃশ্য দেখা যায়, তেমনি হিজড়াদের ভেতরেও রয়েছে সাধারণ মানুষকে নিয়ে ক্ষোভ এবং আক্ষেপ।
হিজড়া জনগোষ্ঠী, যাদের জন্মের সময়ে নির্ধারিত লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে জীবনযাপন পদ্ধতি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় (এ জনগোষ্ঠী নিজেদের চিরাচরিত লিঙ্গের চেয়ে ভিন্ন কিছু ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে)। একজন হিজড়া সাধারণত নিজ আগ্রহে পছন্দের লিঙ্গ পরিচয় এবং এ জীবনযাপন পদ্ধতি বেছে নেন। কিন্তু তারা তাদের পছন্দের লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্থায়ীভাবে শারীরিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করতে পারেন অথবা পারেন না। বাংলা অভিধানে হিজড়া বলতে বোঝানো হয়েছে একই দেহে স্ত্রী ও পুং চিহ্নযুক্ত মানুষ কিংবা অন্য প্রাণী।
আমরা যারা সভ্য সমাজে বাস করি তারা হিজড়াদের সংজ্ঞায়িত করি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে। বিভিন্ন ইন্টারভিউয়ে দেখা যায় হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ বলায় তাদের ভেতর একটা মনঃকষ্ট রয়েছে, আক্ষেপ রয়েছে প্রথম ও তৃতীয় লিঙ্গ সম্পর্কে জানার। হিজড়া বলতেই আমরা আমাদের মনের মধ্যে খারাপ একটা প্রতিবিম্ব ধারণ করি। আসলে হিজড়ারাও তো রক্ত-মাংসে গড়া আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো মানুষ। তবে কেন আমরা তাদের মেনে নিতে পারি না। হিজড়া হয়ে জন্মানো তো তাদের দোষ নয়! অথচ আমরা সভ্য সমাজের মানুষ হয়ে হিজড়াদের সমাজ থেকে, পরিবার থেকে বের হতে বাধ্য করি। তাদের পরিবার তাদের দায় মনে করে অন্য আর পাঁচটা বাচ্চার মতো বেড়ে উঠতে সাহায্য করে না। উল্টো তাদের ঠেলে দেয় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে, যেখানে নেই কোনো ভালোবাসা, নেই কোনো সম্মান। পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোথাও যখন তাদের ঠাঁই হয় না তখন তারা বেছে নেন অপ্রীতিকর পন্থা, যা দেখে আমরা সভ্য সমাজের মানুষ নাক ছিটকাই, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করি। আসলে তো এ দায় তাদের নয়। একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চাই, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার বিড়াল প্রবন্ধে বিড়ালকে চুরি করে খাওয়ার জন্য দোষারাপ করায় বিড়াল প্রত্যুত্তরে বলেছে, ‘চোরকে শাস্তি দেওয়ার আগে তিন দিবস উপবাস করিবেন তাহাতে যদি আপনার চুরি করিয়া খাইতে ইচ্ছা না করে, তাহলে স্বাচ্ছন্দ্যে চোরকে ফাঁসি দিবেন।’ দোষ আমাদের সুশীলসমাজের মানুষের, যারা হিজড়াদের কাছে থেকে সকল অধিকার কেড়ে নিই। কিন্তু জীবন বাঁচানোর তাগিদে তারা যখন অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয় আমরা তাদের দোষারোপ করি, সমাজ নষ্টের কারিগর হিসেবে আখ্যায়িত করি।
সাধারণ মানুষের হিজড়াদের নিয়ে রয়েছে অবহেলা ও বৈষম্য। সেই বৈষম্য দূর করতে সমাজের মূল ধারায় তাদের সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার এবং ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার কারণে হয়তো সুশীলসমাজে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। জন্মের পর হিজড়া হওয়া সত্ত্বেও পরিবার তাদের দায় গ্রহণ না করলেও কিছুটা স্বস্তি মিলেছে হিজড়াদের। তবে হিজড়াদের কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা, চাঁদাবাজি, যৌনাচার, জবরদস্তিমূলক টাকা আদায় ও ভিক্ষাবৃত্তির মতো ঘটনা এখনো দেখা যায়। যার কারণে সমাজে হিজড়াদের এখনো বিড়ম্বনা মনে করা হয়।
আমরা যারা সুশীলসমাজে বাস করি তারা চাইলেই হিজড়াদের পরিবারে, সমাজে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে সমানভাবে সুযোগ করে দিতে পারি। হিজড়াদের বিড়ম্বনা মনে না করে সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে আনতে পারি।
আজকাল দেখা যাচ্ছে তারাও নিজের চেষ্টায় সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পেরেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হিজড়ার নাম শাম্মী, যিনি একজন পার্লারের মালিক। সমাজে কুরুচিপূর্ণ চলাফেরা বাদ দিয়ে কর্মক্ষেত্র তৈরি করেছেন নিজের এবং তার মতো আরো অনেক হিজড়ার। বিবিসি নিউজের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। অনুপ্রাণিত হয়েছেন আরো অনেকে। হিজড়ারা অপ্রীতিকর জীবন ছেড়ে কেবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে অনেক কিছু করতে পারেন তা দেখিয়ে দিয়েছেন। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে করেছেন সাফল্যমণ্ডিত। সময়ের বিবর্তনে হিজড়াদের সম্পর্কে জানা যায় আরো অনেক সুখবর। বর্তমানে বহুল আলোচিত আরেকজন ট্রান্সজেন্ডার নারী তাসনুভা সংবাদপাঠক হিসেবে টিভি চ্যানেলে কাজ করছেন সমাজের কটাক্ষকে উপেক্ষা করে। এছাড়া বলতে পারি রানী চৌধুরীর কথা, যিনি নাচের ওপর ইন্ডিয়া থেকে বিশেষ ট্রেনিং নিয়ে বাংলাদেশে এসে সাত বছর ধরে কাজ করছেন একজন উদ্যোক্তা হিসেবে। জড়িত আছেন বিভিন্ন সংগঠনের সাথে। কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন তার সমগোত্রীয় আরো অনেক হিজড়াকে। জানা ও অজানার মধ্যে আরো অনেক হিজড়া রয়েছেন যারা সমাজের অবহেলার পাত্র হিসেবে থাকতে চান না। তারা দেখিয়ে দিতে চান তারাও পারেন, শুধু দরকার একটা সুযোগ। নিজের চেষ্টায় শিক্ষিত এবং যোগ্য কিছু হিজড়া বিভিন্ন ইন্টারভিউয়ে অভিযোগ করেছেন কর্মক্ষেত্রে তাদের সমান সুযোগ দেওয়া হয় না। অনেক সময় তাদের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য শুনতে হয়, আবার কেউ কেউ করেন প্রশংসা। সমাজ অনেকটা পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। এই পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত রেখে সমাজের একজন বিবেকবান মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত সব ধরনের বৈষম্য দূর করে তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। পরিবার ও সমাজ থেকে মেনে নিয়ে তাদের বিড়ম্বনা মনে না করে সবার উচিত তাদের সম্ভাবনাময় করে গড়ে তুলে সামাজিকভাবে মর্যাদা দেওয়া।
লেখক :রুকাইয়া মাহজাবিন
শিক্ষার্থী সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়