বাংলাদেশের তরুণ মেধাবী প্রোগ্রামারদের আরো বেশি কার্যকর করে তোলার লক্ষ্যে ও স্বীকৃতি দিতে বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা ‘ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং আইসিপিসি-২০১৮’ অনুষ্ঠিত হয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ কম্পিউটার প্রোগ্রামিং কনটেস্টে অংশগ্রহণ করে মোট ২৯৮টি দল। গত ১১ নভেম্বর সাড়া জাগানো এই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দল সাস্ট ডেসসিফ্রেডর। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মো. শফিকুল ইসলাম
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাস আশুলিয়ার স্বাধীনতা মিলনায়তনে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে শত শত শিক্ষার্থীর গায়ে হলুদ টি-শার্ট। এমন শত শত হলুদ ফুল যেন চারদিকের দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। এই দিনে সারা দেশের ১০১টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন আইটি ইনস্টিটিউটের দলগুলো একমঞ্চে জড়ো হয়েছিল এইদিনে। কারণ এখানে বসেছিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং আইসিপিসি ঢাকা অঞ্চলের আসর। প্রতিটি দলের সদস্য সংখ্যা তিনজন। তাদের চোখে-মুখে নতুন কিছু আবিষ্কার করার নেশা। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন এসব মেধাবী তরুণের হাত ধরেই এগিয়ে যাবে।
দেশের দল ছাড়াও নেপাল থেকে আসা তিনটি দল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। এক হাত ল্যাপটপের কি-বোর্ডে, আরেক হাত মাথায়। চোখ দুটি স্থির ল্যাপটপের মনিটরে। গভীর মনোযোগে প্রোগ্রামিং সমস্যার সমাধান করছেন কলোজ যোশি। তার গায়ের হলুদ টি-শার্ট যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন নেপালি এই তরুণ। দুই বন্ধু অসীম বুদ্ধ ও সন্দ্বীপ পাখরে তার পাশে আছেন। তারা নানাভাবে সাহায্য করছেন কলোজ যোশিকে।
সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা পাঁচ ঘণ্টার প্রতিযোগিতা শেষে চ্যাম্পিয়ন শিরোপা অর্জন করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দল সাস্ট ডেসসিফ্রেডর। প্রতিযোগিতার সাতটি সমাধানের মধ্যে ছয়টি সমাধান করে চ্যাম্পিয়ন দলটি। দলের সদস্যরা হলেন আরাফ অভিষেক, অভিষেক পাল ও মওদুদ আহমেদ খান। বিজয়ী দলের আরাফ বলেন, এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। খুবই ভালো লাগছে। আগামী ওয়ার্ল্ড ফাইনাল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দেশের জন্য সম্মানজনক পুরস্কার নিয়ে আসব ইনশাল্লাহ। তার উচ্ছ্বাস থামলে খানিকটা ধীরকণ্ঠে অভিষেক পাল বলেন, আঞ্চলিক পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, এখন টার্গেট আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়া। সেভাবে নিজেকে এখন প্রস্তুত করতে হবে। এই সুযোগে দলের অন্য সদস্য মওদুদ আহমেদ খান, ঢাকা অঞ্চলের প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন ও রানার আপ দল আগামী বছরের ৩১ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্তুগালের ইউনিভার্সিটি অব পোর্টোয় ওয়ার্ল্ড ফাইনাল প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে।
এখন নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে রানার আপ তবে হলো কারা? এই প্রতিযোগিতায় রানার আপ হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দল ‘বুয়েট-ব্লাডহুন্ড’। দলটি সমাধান করেছে পাঁচটি সমস্যা। দলের সদস্যরা হলেন মুত্তাকিন আশিকুল, আশিকুল ইসলাম ও অর্ঘ পাল। মুত্তাকিন তার অনুভূতি প্রকাশ করেন এভাবে- আমাদের লক্ষ্য ছিল চ্যাম্পিয়ন হওয়া। কিন্তু সেটা হতে পারিনি বলে আমরা খুব হতাশ নই। এখনো আমাদের সামনে সুযোগ আছে ওয়ার্ল্ড ফাইনালে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়ার। সেখানে ভালো করার জন্য নিজেদের দক্ষতা আরো শাণিত করব। মুত্তাকিনের কথার সঙ্গে একমত পোষণ করে অর্ঘ পাল বলেন, আমাদের হাতে আছে তিন মাস। এ সময়ের মধ্যে নিজেদের মেধা ও যোগ্যতাকে আরো ঝালিয়ে নিতে হবে।
বুয়েট-ব্লাডহুন্ড দলের সদস্যরা যখন তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানাচ্ছিলেন, তখন অদূরে দেখা গেল ট্রফি নিয়ে সেলফি তোলায় ব্যস্ত দ্বিতীয় রানার আপ বিজয়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দল ‘ডিইউ-এপিনেফ্রিন’-এর সদস্য পিয়াল রেজওয়ান, রেজওয়ান আহমেদ ও শাহেদ শাহরিয়ারকে। তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে পিয়াল জানান, এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমরা নিজেদের কিছু সীমাবদ্ধতা শনাক্ত করতে পেরেছি। এখন চেষ্টা করব এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার এবং আগামী প্রতিযোগিতায় ভালো করার।
এই প্রতিযোগিতায় সেরাদের তালিকায় আরো একটি দল রয়েছে ‘ডিআইইউ হিউরেস্টিক’। ‘বেস্ট গার্ল টিম’ নির্বাচিত হয়েছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এই দলটি। দলের সদস্যরা হলেন হোসেন তানজিনা আফরোজ, ইশরাত জাহান ফাতেমা ও তানজিনা আফরোজ রিমি। মেয়েদের মধ্যে সেরা দল নির্বাচিত হওয়ায় তারা ভীষণ উচ্ছ্বসিত। হোসেন তানজিনা বলছিলেন, যে কোনো পুরস্কারই অনুপ্রেরণা জোগায়। আমরা ভীষণ অনুপ্রাণিত। ভবিষ্যতে আমরা আরো ভালো করব, ইনশাল্লাহ।
তানজিনাদের সঙ্গে কথা শেষ করে পেছনে তাকাতেই আবার দেখা হয় কলোজ যোশি, অসীম বুদ্ধ ও সন্দ্বীপ পাখরের সঙ্গে। ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশি বন্ধুদের ফোন নম্বর ও ফেসবুক আইডি সংগ্রহ করে নিচ্ছে তারা। মুখে একরাশ হাসি ছড়িয়ে অসীম বুদ্ধ বলেন, পুরস্কার পাইনি তো কী হয়েছে! এই যে এতগুলো বাংলাদেশি বন্ধু পেলাম, এটাই বা কম কিসের?
এবারের প্রোগ্রামিং কনটেস্টটিকে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় করে রাখার জন্য আয়োজকদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ছিল নজরকাড়া। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে আগামী ওয়ার্ল্ড ফাইনালে ভালো করার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করা হয়েছে। এভাবেই সারাদিন কেটে গেল তরুণ প্রোগ্রামারদের।