প্রায় ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কাজ করে যাচ্ছেন এম রাশিদুল হাসান। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দেশীয় সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিসটেক ডিজিটাল লিমিটেডে। এ ছাড়াও দুবার সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন দেশের সফটওয়্যার-বাণিজ্য খাতের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইনফরমেশন অ্যান্ড সার্ভিসেসে (বেসিস)।
সম্প্রতি জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত ‘অ্যাসোসিও ডিজিটাল মাস্টার্স সামিট ২০১৮’-তে ‘বায়োমেট্রিক আইডেন্টিটি অ্যান্ড ওয়ার্কার ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ওয়ার্কার ডাটাবেজ)’ ব্যবহারের জন্য এশিয়া এবং ওশেনিয়া অঞ্চলের ২৪টি ইকোনমি দেশ নিয়ে এশিয়ান-ওশেনিয়া কম্পিউটিং ইন্ডাস্ট্রি অর্গানাইজেশনের (অ্যাসোসিও) পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ। আর এই ডাটাবেজ ও সফটওয়্যার তৈরির পেছনে কাজ করেছে রাশিদুল হাসানের প্রতিষ্ঠান সিসটেক। এই অর্জন, সফটওয়্যারের কাজ, সুবিধা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশের খবরের সঙ্গে কথা হয় রাশিদুল হাসানের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম. রেজাউল করিম।
বাংলাদেশের খবর : কবে থেকে প্রকল্প শুরু হয়েছিল?
রাশিদুল হাসান : ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী এই বায়োমেট্রিক আইডেন্টিটি অ্যান্ড ওয়ার্কার ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ওয়ার্কার ডাটাবেজ) প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। ওই বছর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আশুলিয়ার ২৮৫টি ফ্যাক্টরিতে এই ডাটাবেজের সফটওয়্যার ইনস্টল করি। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালে সারা দেশের ফ্যাক্টরিতে এটা ইনস্টল করা শুরু হয়। চলতি বছরের অক্টোবর অনুযায়ী ২ হাজার ৩০০ ফ্যাক্টরিতে আমাদের এই সফটওয়্যার ইনস্টল করা হয়। যা চলমান প্রক্রিয়ায় আছে, প্রতিদিনই এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই ডাটাবেজে প্রায় ৩৬ লাখের মতো শ্রমিকের তথ্য অন্তর্ভুক্ত আছে।
বাংলাদেশের খবর : এই সফটওয়্যারের মূল কাজ কী?
রাশিদুল হাসান : সফটওয়্যারটি মূলত পোশাক নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের বিস্তারিত তথ্য, যেমন-একজন শ্রমিকের নাম, মা-বাবার নাম, ঠিকানা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, কর্ম অভিজ্ঞতা, শেষ কোন ফ্যাক্টরিতে কাজ করেছে, কোন পদে কাজ করছে বা করছে, বেতন কত ছিল-এসব তথ্য অন্তর্ভুক্ত করে তা স্থানীয় ও ক্লাউড সার্ভারে জমা করে। যা পরবর্তী সময়ে অন্যান্য ফ্যাক্টরির শ্রমিকের সঙ্গে সবধরনের শনাক্ত ও নিশ্চিতকরণ করা যায়। যেমন- কোনো ফ্যাক্টরিতে নতুন শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে তাকে যাচাই-বাছাই করে নেওয়ার সুযোগ থাকে। কারণ, নিয়োগদাতা তার কাছে থাকা সফটওয়্যারে কর্মীর ফিংগারপ্রিন্টের মাধ্যমে তার পূর্ব ইতিহাস জেনে নিতে পারেন। এ ছাড়াও এই ডাটাবেজের ওপরই এখন মালিকরা গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স করতে পারেন। এই সফটওয়্যারের সেন্ট্রাল ডাটাবেজ থেকে শ্রমিকদের মোবিলাইজেশন করা যায়। কোন এরিয়াতে কতজন পুরুষ, কতজন নারী শ্রমিক আছে, কোথায় শ্রমিকদের বেতন রেশিও কত, কোথায় শ্রমিকের প্রয়োজন বেশি- এ ধরনের বিজনেস ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট পায় বিজিএমই এবং সরকার।
এ ছাড়াও সার্ভিস বুক, ইউডি, ক্যাশ ইনসেনটিভ ও অন্যান্য কাজের জন্য এই তথ্য ভান্ডার থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এক-ক্লিকেই সব-ধরনের তথ্য সরবরাহ করে।
বাংলাদেশের খবর : এই ডাটাবেজে থাকা তথ্যগুলো কতটুকু নিরাপদ?
রাশিদুল হাসান : আমাদের সফটওয়্যারের তথ্যগুলো একেবারেই এনক্রিপ্টেডভাবে আদান-প্রদান করা হয়। তাই আমরা এই তথ্য বেহাত হওয়া থেকে সুরক্ষিত বলে আশাবাদী। কারণ, আমরা ডাটা স্টোরেজ করেছি নিজস্ব এনক্রিপশনের মাধ্যমে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট তো এনক্রিপ্টেড করাই, পাশাপাশি আমরা যে ছবিটি তুলি, সেটা ফ্যাক্টরি থেকে যখন সেন্ট্রাল ডাটাবেজে ট্রান্সফার হয় তখন সেটাও এনক্রিপটেড হয়ে যায়। আবার যখন এটা দেখার প্রয়োজন হয়, তখন সেটা বাইনারি ডাটা হয়ে নামে। এরপর ফ্যাক্টরিতে যেই সফটওয়্যার আছে সেখানে কনভার্টেড হয়ে নামে। এটা এই সফটওয়্যারের একটা বড় সুবিধা বলেও মনে করা যায়।
বাংলাদেশের খবর : এখন আর কী কী নিয়ে কাজ করছেন?
রাশিদুল হাসান : আমরা এখন জাপান থেকে বেশকিছু প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি। যেগুলো চুক্তি অনুযায়ী খোলাসা করা যাচ্ছে না। তবে ভুটান সরকারের একটি সফটওয়্যারের কাজ আমরা করেছি। যা ইতোমধ্যেই আমরা তাদের কাছে হ্যান্ডওভারও করে দিয়েছি। এটা মূলত যা সোশ্যাল এন্ট্রাপ্রেনারশিপ ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট নামে সার্কের একটি প্রকল্প। যেটি বাস্তবায়নে ভুটান সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেটারই একটা ক্লাউড অ্যাপ্লিকেশনের কাজ আমরা আন্তর্জাতিকভাবে বিট করে পেয়েছিলাম। এ ছাড়াও আমরা নিজস্ব একটি এইচআরএম সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করছি। যেটা আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যমান সব সফটওয়্যারে যত ফিচার আছে, সেসব ফিচার নিয়ে আমাদের এই এইচআরএম সফটওয়্যারে পাওয়া যাবে। যা ইতোমধ্যেই ঢাকা চেম্বার, বেসিসসহ দেশের অন্যান্য বড় বড় প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে। সেই সফটওয়্যারটিই এখন আমরা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশের খবর : আমাদের দেশে প্রচুর মানবসম্পদ আছে। তাদের ব্যবহার করে বিরাট কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব কি না?
রাশিদুল হাসান : অবশ্যই সম্ভব। আমি যেহেতু বিজিএমইএর সঙ্গে অনেক কাছে থেকে কাজ করেছি। আমি দেখেছি, সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশ থেকে আরএমজি প্রোডাক্ট নিতে আসার একমাত্র কারণ হচ্ছে কম দামে ভালো মানের পণ্য সময়মতো ডেলিভারি পাওয়া। যদিও এখানে কাটা, সেলাই, বুনন ও কিছু অন্য কাজ হয়। বাকি অধিকাংশ জিনিস বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। এখানে ভ্যালু এডিশন, কিন্তু খুব বেশি নেই। কিন্তু আমি হোপ দেখি, আমাদের যেই নতুন জেনারেশন আছে। তাদের যদি আইটিতে, নলেজ ইকোনমিতে কনভার্ট করতে পারি। তাদের মাথায় যদি এই প্রযুক্তি ঢুকিয়ে দিতে পারি। এমন নয় যে, তাদের প্রোগ্রামারই হতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের মাথায় যদি বিভিন্ন কাজ করাতে পারি। আইটি এনাবেল বিভিন্ন কাজ, বিজনেস প্রসেস, আউটসোর্সিংসহ অনেক কাজই আছে। সেগুলো যদি আমরা করতে পারি। তাহলে কিন্তু ভ্যালু এডিশন অনেক বেড়ে যাবে। আর এজন্য একটি নির্দেশনা দরকার। কারণ প্রোপার নির্দেশনা না পেলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আর সরকারও চায়, আমরা আইটিতে রফতানিমূলক দেশ হব। তাই আরএমজির মতো আমরাও অনেক ভালো করতে পারব। এজন্য আমাদের আরো সঠিক পরিকল্পনা করতে হবে। আমাদের সারা দুনিয়াকে জানাতে হবে, তুমি যদি আমার কাছে বিপিও, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব ডিজাইন তথা আইটির কাজগুলো কর; আমি তাহলে সুলভ মূল্যে, ভালো মানের কাজ সঠিক সময়ে ডেলিভারি দিতে পারব। আমাদের প্রচুর মানবসম্পদ আছে। এই অফারগুলো আমাদের বিশ্ববাসীকে জানাতে হবে যে, এই দেশ থেকে তোমরা লো কস্টে হাই কোয়ালিটির কাজ পাবে। আমাদের কোম্পানিগুলোকে সঠিকভাবে তৈরি করতে হবে, তাদের ফিন্যান্সিয়াল একসেস আরো ইজি করতে হবে। ইন্টারনেট কানেকটিভিটি আরো কম খরচে এবং বেশি ব্যান্ডউইথে পাওয়া দরকার।
এ ছাড়াও আরেকটি কথা না বললেই নয়, আমাদের দেশে বর্তমানে যত ট্রেনিং চলছে, এগুলোর মার্কেট ধীরে ধীরে কমে আসছে। কারণ, টেকনোলজি আপগ্রেড হচ্ছে, নিত্যনতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার হচ্ছে। তাই আমাদের দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হলে উন্নত দেশগুলোতে ব্যবহূত প্রযুক্তি নিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। একই সঙ্গে প্রশিক্ষণার্থীদেরও উদ্ভাবনী মনোভাব থাকতে হবে। তাহলেই আমরা তথ্যপ্রযুক্তিতে আরো দক্ষ হব এবং উদ্ভাবনী মনোভাবাপন্ন মানবসম্পদই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবে।
বাংলাদেশের খবর : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
রাশিদুল হাসান : ২০১৯ সালে আমরা বেশকিছু প্রোডাক্ট নিয়ে আসছি। যেখানে আমরা বেশকিছু ইনোভেটিভ সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করছি। এগুলোর মধ্যে বলা যায়, আমরা ইতোমধ্যেই যেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে কাজ করছি, সেগুলোতে আমরা আমাদের নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহার করেছি। এ ছাড়াও বিজেএমইএর ডাটাবেজ বানাতে যেই ক্যামেরা দিয়ে আমরা ছবি তুলেছিলাম, সেটার মধ্যেও পরীক্ষামূলকভাবে আমাদের নিজস্ব সফটওয়্যার এম্বেড করেছিলাম। এই এম্বেডেড সিস্টেমে কাজ করতে গিয়ে যেহেতু আমরা অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা চায়নার কয়েকটি ফ্যাক্টরির সঙ্গে কথা বলেছি। যেহেতু আমাদের দেশে এ ধরনের প্রোডাক্ট উৎপাদন হয় না। তাই ওই কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আমরা জয়েন্টভেঞ্চারে মেশিনগুলো বানাব আর সেখানে আমাদের নিজস্ব সফটওয়্যার ও সার্ভার সেটাপ করে দেব।