প্রফেসর শাহ আলম
ঢাকা নামকরণে ঐতিহাসিক অনেক মত রয়েছে। ঢাক গাছে আচ্ছাদিত, ঢাক বা অস্পষ্ট প্রাকৃত ভাষায় যারা কথা বলে, দুর্গা ও তার চার সন্তান- লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশকে জলে ঢেকে দেয়া, রাজা বল্লাল সেনের ঢাকেশ্বরী বা ঈশ্বরের আশীর্বাদে ঢাকা, সুবেদার ইসলাম খানের ঢাক বাজানোর শব্দ বুড়িগঙ্গার তীর থেকে যতদূর শোনা যায় ততদূর শহরের সীমারেখা অথবা প্রকৃতির প্রাচুর্যে ঢাকা বা ভরপুর যে শহর, তাকেই ঢাকা বলে।
খ্রিস্টপূর্ব ৯৫০ অব্দে সম্রাট বালি ও স্ত্রী সুদিঙ্গার পুত্র বঙ্গের সময় বঙ্গ প্রাচুর্যে ভরা ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ও পরে চীনা পর্যটকরা এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ইবনে বতুতা বলেছেন, ‘নিয়ামতে পুর বা আশীর্বাদে ভরা’ এ শহর। তখন রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। সুলতান গিয়াস উদ্দিন বাংলা থেকে মক্কা-মদিনায় দুটি মাদরাসা স্থাপন, হাজিদের পানির ব্যবস্থার জন্য জেদ্দা থেকে খালখনন করেন। ঢাকা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ মুর্শিদাবাদে যেত। পূর্ববঙ্গের সোনালি আঁশের টাকায় কলকাতা গড়ে ওঠে। ’৪৭-এ দেশভাগের সময় ঢাকা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়। সমস্ত কলকারখানা কলকাতায় গড়ে ওঠে। ঢাকাকে বঞ্চিত করতে বঙ্গভঙ্গ রদ হয় ১৯১১ সালে। বঙ্গভঙ্গ রদকে কেন্দ্র করে ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্রিটিশ সরকার কলকাতার আন্দোলনে নারাজ হয়ে ১৯১১ সালে সেখান থেকে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তর করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে পূর্ববঙ্গে জনসচেতনতা বেড়ে যায়। তাদের ও মুসলিম লীগের আন্দোলনের ফলে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সৃষ্টিতে পূর্ববঙ্গের অবদান বেশি। পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৭ কোটি লোকের রক্তে ঝরা সোনালি আঁশের টাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের ৫ কোটি লোকের জন্য রাজধানী করাচি ও ইসলামাবাদ গড়ে ওঠে। সে সময় ঢাকা তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তখন ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল ৭ লাখ, করাচিতে ছিল ৩৫ লাখ, কলকাতায় ছিল ৭৪ লাখ। বর্তমানে কলকাতার লোকসংখ্যা দেড় কোটি, ওয়ার্ড সংখ্যা ১৫টি। আজ ঢাকাবাসীর সংখ্যা ২ কোটির উপরে। যে হারে বাড়ছে, আগামী ২০২৫ সালের নির্বাচনে লোকসংখ্যা দাঁড়াবে আড়াই কোটির উপরে। ২০২৫-৩০ এর মধ্যে ঢাকার সীমানা পূর্বাচল, ঝিলমিল, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও সাভার পর্যন্ত বর্ধিত হবে। তখন সিঙ্গাপুরের মতো দেশের মোট আয়তনের চেয়ে ঢাকার আয়তন বড় হবে। বর্তমানে ঢাকা মেগাসিটি ৭ নম্বরে, তখন টোকিও, দিল্লির কাছাকাছি চলে যাবে। অর্থনীতিতে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশিরা ধনী হবে। পূর্বাচলে আইকনিক টাওয়ার হবে খলিফা বুর্জের পরে। তখন হয়তো ঢাকা চারটি সিটি করপোরেশনে বিভাজন হবে, যথা-উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম।
প্রধানমন্ত্রী সে লক্ষ্যেই ঢাকাকে ২০১১ সালে দুই ভাগে বিভক্ত করেন ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ।
১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে সুবেদার ইসলাম খাঁ ৩ হাজার লোক আর ২ বর্গকিলোমিটার নিয়ে এ শহরটির ভিত্তিপ্রস্তর ও নামকরণ করেন জাহাঙ্গীরনগর। সুলতানি আমলে সোনারগাঁ, মোগল আমলে জাহাঙ্গীরনগর, ব্রিটিশরাজ ঢাকার পুরনো নাম বহাল রাখেন। ১৮২৩ সালে ওসঢ়ৎড়াবসবহঃ ড়ভ উযধশধ বা ঢাকা উন্নয়ন গঠিত হয়। ১ আগস্ট ১৮৬৪ ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি গঠিত হয়। এর প্রথম চেয়ারম্যান মনোনীত হন ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট মি. স্কিনার। ১৮৮৫ সালে ঢাকাবাসী প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান হন আনন্দ চন্দ্র রায়। ১৮৯১ সালে প্রথম মুসলিম নির্বাচিত চেয়ারম্যান হন খাজা মো. আজগর।
লর্ড মেয়ো ১৮৭০ সালে ঢাকার পুরনো প্রথা পঞ্চায়েত ও চৌকিদারি আইন পাস করেন। মেয়াদকাল ছিল তিন বছর, সদস্যসংখ্যা ছিল পাঁচজন। ১৮৮৫ সালে ইউনিয়ন কমিটি গঠিত হয়, সদস্যসংখ্যা ৫ জন। ১৯১৯ সালে ইউনিয়ন বোর্ড গঠিত হয়, জেলা প্রশাসক ১/৩ অংশ, জনগণ ২/৩ অংশ সদস্য, একজন প্রেসিডেন্ট ও একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতেন, মেয়াদকাল ছিল ৩ বছর। ১৯৩৬ সালে মেয়াদকাল তিন বছরের স্থলে চার বছর করা হয়। ১৯৪৬ সালে তা বাতিল করা হয়। ১৯৫৯ সালে ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করা হয়। সদস্যসংখ্যা ছিল ১০-১৫ জন, ২/৩ অংশ জনগণ, ১/৩ অংশ প্রশাসন নির্বাচন করত। ১৯৬২ সালে সদস্যরা তাদের মধ্য থেকে একজন চেয়ারম্যান ও একজন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচন করতেন। পরবর্তীকালে ভাইস চেয়ারম্যান পদটি স্থগিত হয়, মেয়াদকাল ছিল ৫ বছর।
জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রথম মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, মেয়াদকাল ১৯৯৪-২০০২। ঢাকা উত্তরের প্রথম মেয়র আনিসুল হক, মেয়াদকাল ২০১৫-২০১৭, ঢাকা উত্তরের উপনির্বাচিত মেয়র আতিকুল হাসান, মেয়াদকাল ২০১৯ সালের ৭ মার্চ থেকে ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর এবং দক্ষিণের প্রথম মেয়র সাঈদ খোকন, মেয়াদকাল ২০১৫-২০২০।
বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সর্বমোট ওয়ার্ড সংখ্যা ৭৫টি, সংরক্ষিত ২৫টি। পুরুষ ভোটার ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৪৪১, মহিলা ভোটার ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৩। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সর্বমোট ওয়ার্ড সংখ্যা ৫৪টি, সংরক্ষিত ১৮টি। পুরুষ ভোটার ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৬৭, মহিলা ভোটার ১৪ লাখ ৬০ হাজার ৭০৬।
নতুন সৃষ্ট ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে ৫৩ নং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এ ওয়ার্ডের আওতায় নির্মিত হচ্ছে মেট্রোরেল ও উত্তরা তৃতীয় প্রকল্প। যেখানে গড়ে উঠবে নতুন নতুন আবাসন ও অত্যাধুনিক সুরম্য অট্টালিকা, যা সিঙ্গাপুর ও বিশ্বের অন্যান্য শহরকে হার মানাবে। এটাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০২১-২০৪১।