মুক্তমত

ঢাকাই মসলিনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে

  • প্রকাশিত ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

মুশফিকুর রহমান ইমন

 

 

একটি জাতির অস্তিত্বের পেছনে জড়িয়ে থাকে সে জাতির সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বাঙালিরা তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের যে সামান্য কিছু বিষয় বা বস্তু নিয়ে গর্ববোধ করত এবং এখনো করে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো ঢাকাই মসলিন কাপড়। সম্প্রতি ঢাকাই মসলিনের পুনর্জন্মের খবরে বাঙালি হিসেবে নতুন এক আশার আলো খুঁজে পাচ্ছি। বাংলাদেশের ঐতিহ্যের কথা বললে, ইতিহাসের কথা বললে মসলিনকে বাদ দেওয়ার কোনো উপায় নেই। মসলিন তার সূক্ষ্মতার জন্যই সারা বিশ্বে বিখ্যাত ছিল। ভারতের মুঘল রাজপরিবার তো বটেই এমনকি ব্রিটিশ রাজরানিদেরও প্রথম পছন্দের কাপড় ছিল ঢাকাই মসলিন। কিন্তু এই বিখ্যাত কাপড়টির যেমন রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল স্বর্ণযুগ, তেমনি রয়েছে কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার এক করুণ ইতিহাস।

বাংলা মসলিন শব্দটি এসেছে ‘মসুল’ থেকে। ইরাকের এক বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র হলো মসুল। এই মসুলেও অতি সূক্ষ্ম কাপড় প্রস্তুত হতো। ‘মসুল’ এবং ‘সূক্ষ্ম কাপড়’-এ দুয়ের যোগসূত্র মিলিয়ে ইংরেজরা অতি সূক্ষ্ম কাপড়ের নাম দেয় মসলিন। অবশ্য বাংলার ইতিহাসে ‘মসলিন’ বলতে বোঝানো হয় তৎকালীন ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে উৎপাদিত অতি সূক্ষ্ম একধরনের কাপড়কে। ফুটি কার্পাস নামক গাছের তুলা থেকে তৈরি করা হতো এ সূক্ষ্ম মসলিন কাপড়। মসলিনের তুলা ছিল অন্যান্য জাতের চেয়ে ভিন্ন। আর মসলিন কাপড় বোনার ক্ষেত্রে তুলা থেকে সুতা তৈরি ও সুতা দিয়ে কাপড় বোনা প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি নিয়ামক ছিল। ঠান্ডা ও শীতল আবহাওয়ার আর্দ্রতা মসলিনের সুতা কাটার জন্য বেশ উপযোগী। ফলে নাতিশীতোষ্ণ বাংলার এই আবহাওয়া মসলিন কাপড় বোনার জন্য বেশ উপযোগী ছিল।

মসলিনের পথ চলা শুরু হয়েছিল আজ থেকে ৪০০ বছর আগে থেকে। বঙ্গদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশসহ ভারতের পশ্চিম বাংলার উৎপাদিত মসলিন সুদূর চীন, আমেরিকা, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ইতালি, মিশর, ইউরোপসহ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি’ শীর্ষক গ্রন্থে মসলিন সম্পর্কে বিশেষ ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। রোমানরা মসলিনের খুব কদর করত। রোমানরাই ইউরোপে প্রথম মসলিন কাপড়ের ব্যবসা চালু করে এবং ধীরে ধীরে এটি প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে। মসলিনের সূক্ষ্মতার দিকটি ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা থেকে জানা যায়। ইতিহাসে আছে, মুঘল আমলে তৈরি করা ঢাকাই মসলিন ঘাসের ওপর রাখলে এবং তার ওপর শিশির পড়লে কাপড় দেখাই যেত না। কয়েক গজ মসলিন কাপড় ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া যেত বলে জনসাধারণ একে ‘হাওয়ার কাপড়’ বলত। এমনকি একটি আংটির ভেতর দিয়ে এক থান কাপড় অনায়াসে টেনে বের করা যেত। দিয়াশলাইয়ের বাক্সেও এই সূক্ষ্ম মসলিন রাখা যেত।

বহু বিদেশি পর্যটক বাংলা ভ্রমণে এসে মসলিনের বুনন কৌশল ও কাপড়ের নিপুণতা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। খ্রিস্টীয় নবম শতকে আরব পর্যটক ও ভূগোলবিদ সুলেইমান রচিত ‘সিলসিলাত-উত্-তাওয়ারিখ’ শীর্ষক গ্রন্থে মসলিনের সূক্ষ্মতার বর্ণনা পাওয়া যায়। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি ইবনে বতুতা ও পঞ্চদশ শতকে চীনা পর্যটক মাহুয়ান বাংলার মসলিন দেখে আশ্চর্যের সাথে প্রশংসা করেন। এরপর ষোড়শ শতকে ইংরেজ পর্যটক রলফ ফিচ, পর্তুগিজ পর্যটক ডুয়ার্টে বারবোসা এবং অষ্টাদশ শতকের ডাচ পর্যটক স্ট্যাভোরিনাস বাংলাদেশের কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলে মসলিন তৈরি প্রত্যক্ষ করেন এবং মসলিনের সূক্ষ্ম ও মিহি বুননের প্রভূত প্রশংসা করেন। এছাড়া বাংলাদেশে তৈরি মসলিনের সূক্ষ্ম, মিহি ও দৃষ্টিনন্দন বুননে বিস্ময় প্রকাশ করেন ইংরেজ কোম্পানির সরকারি ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম। তিনি খ্রিস্টীয় ১৭৫০ সালে বাংলাদেশে অবস্থান করার সূত্রে মসলিনের বুনন ও ঐতিহ্য প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হন। ব্রিটেনের কার্পাসশিল্পের ইতিহাসপ্রণেতা বেইন্সকে বাংলার মসলিন এতটাই বিস্ময়ের ধাঁধায় ফেলে দেয় যে তিনি বলতে বাধ্য হন— এগুলো কোনো পরী বা কীটপতঙ্গের বোনা। মানুষের দ্বারা এ বুনন সম্ভব নয়।’ আসলে মসলিনের সূক্ষ্মতার যে বর্ণনা কালে কালে ইতিহাসের পাতায় গাঁথা আছে তাকে বাস্তব মনে হয় না, রূপকথার গল্পের মতো শোনায়। কিন্তু তার বাস্তব ইতিহাস বহু দেশের বহু ঐতিহাসিকের তথ্যে প্রমাণিত।

বাংলার মসলিন শিল্প তার সোনালি সময়ে ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। একটি শিল্প গড়ে ওঠা, টিকে থাকা কিংবা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পেছনে কাজ করে অনেক ভৌগোলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক নিয়ামক। বাংলায় গড়ে ওঠা মসলিন শিল্পও এর ব্যতিক্রম নয়। মুঘলদের পরাজিত করে ব্রিটিশ বেনিয়ারা বাংলা দখলের আগেই বুঝতে পেরেছিল, তাদের বিলেতি শাড়ির একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হলো ঢাকার মসলিন। তাই তারা মসলিনকে চিরতরে দূর করে দিতে চাইল। প্রথমেই তারা মসলিন কাপড়ের ওপর অত্যধিক শুল্ক বা ট্যাক্স চাপিয়ে দিল। বিলেত থেকে আমদানি করা কাপড়ের ওপর শুল্ক ছিল ২-৪%। কিন্তু মসলিনসহ দেশি কাপড়ের ওপর তারা ট্যাক্স বসালো ৭০-৮০%। তাই দেশে যেমন বিলেতি কাপড় সুলভ হলো, একই সাথে ব্যয়বহুল হয়ে উঠল মসলিনসহ দেশি কাপড়। প্রতিযোগিতায় তাই মসলিন টিকতে পারছিল না। কিন্তু তারপরও টিকেছিল মসলিন। এবার ইংরেজ শাসকরা নিষেধাজ্ঞা জারি করল মসলিন তৈরির ওপর। তাদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেও চলল মসলিনের উৎপাদন। তখন ব্রিটিশরাজ চড়াও হলো মসলিনের কারিগরদের ওপর। তারা মসলিন কারিগরদের ধরে ধরে তাদের হাতের আঙুল কেটে দেয়া শুরু করল, যাতে গোপনে গোপনে তারা মসলিন তৈরি করতে কিংবা এর নির্মাণকৌশল অন্যদের শিক্ষা দিতে না পারে। এভাবেই একদিন বাঙালিরা হারিয়ে ফেলল তাদের গর্বের মসলিন তৈরির প্রযুক্তিজ্ঞান।

এরপর বহুকাল বাংলার মসলিনের সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ধুলোয় চাপা পড়ে ছিল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটি গবেষকদল মসলিন কাপড় ফিরিয়ে আনার একটি প্রকল্প হাতে নেয় ২০১৪ সালে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে গবেষকরা ছয় বছর প্রচেষ্টা চালিয়ে ঢাকাই মসলিনকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। সত্যিই নতুন বছরে জাতির জন্য অত্যন্ত আনন্দের খবর!

আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মসলিন শিল্পের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। বাঙালি নারীর অস্তিত্বের সাথে জামদানি শাড়ির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এ শিল্প আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। বিশ্বের দরবারে বাঙালিকে একটি সংস্কৃতি-সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় এই ঐতিহ্যের ঢাকাই মসলিন। তাই সুযোগ এসেছে আবারো বাঙালির সমৃদ্ধ এই শিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার। সরকারের সজাগ দৃষ্টি, কার্যকর পদক্ষেপ ও আমাদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করতে হবে আমাদের এই শিল্পকে এবং ফিরিয়ে আনতে হবে আমাদের গৌরবান্বিত ঐতিহ্য ও নিজস্বতার ধারক এই মসলিন শিল্পকে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads