রাজিয়া সুলতানা
দেখতে ড্রাগনের চোখের মতো বলেই ফলটির নাম পিটাইয়া বা ড্রাগন ফল। ড্রাগন ফল খেতে হালকা মিষ্টি। ড্রাগন এক ধরনের ফণীমনসা (ক্যাকটাস) প্রজাতির ফল। গাছের কোনো পাতা নেই। সাদা রঙের ফুল রাতের বেলায় ফোটে। ফুল থেকে লাল রঙের ডিমের আকৃতির ফল হয়। ফলের খোসা বেশ নরম। পাকা ফলের শাঁস খুব নরম ও ভেতরে কালোজিরার মতো ছোট ছোট বিচি থাকে। ড্রাগন থাইল্যান্ডের জাতীয় ফল হলেও ফলটি এসেছে মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। তবে বর্তমানে এগুলো পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়ায় ব্যাপক চাষ হচ্ছে। এ ছাড়া ওকিনাওয়া, হাওয়াই, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, উত্তর অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ গণচীনেও ড্রাগন চাষ চোখে পড়ে।
ড্রাগন মূলত বিদেশি ফল হলেও এখন আমাদের দেশেও চাষ হচ্ছে। তবে আশার খবরটি হলো, ড্রাগন ফল বাংলাদেশের আবহাওয়ায় অভিযোজিত। তাই বাণিজ্যিকভাবেও এই ফলের আবাদ সম্ভব। বিশেষ করে রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, বগুড়া, চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ড্রাগন ফলের চাষ হচ্ছে। উপযোগী জাত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সফলভাবে চাষ করার জন্য বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে অবমুক্তায়িত বাউ ড্রাগন ফল-১ (সাদা), বাউ ড্রাগন ফল-২ (লাল) ভালো। এছাড়া হলুদ ড্রাগন ফল ও কালচে লাল ড্রাগন ফলও চাষ করা যায়।
আমাদের দেশে বেলে দোআঁশ থেকে নোনা মাটি— সব জায়গায় সফলভাবে জন্মে। সফল চাষাবাদের জন্য ড্রাগন গাছ ফণীমনসা বা ক্যাকটাস জাতীয় গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না, তাই উঁচু জায়গা নির্বাচন করতে হবে। শুষ্ক জলবায়ু দরকার ও মাঝারি বৃষ্টিপাত ভালো। তবে অধিক বৃষ্টি হলে ফুল ঝরে যায় ও ফলে পচন ধরে। রোদ, খোলামেলা জায়গায় প্রচুর জৈব সারে গাছের বৃদ্ধি ভালো হয়। ড্রাগন ফলের চারা তৈরি খুব সহজ। বীজ দিয়ে চারা তৈরি করা যায়। তবে কাটিং করে শাখা কলম করে চারা তৈরি করা উত্তম। বয়স্ক ও শক্ত শাখা এক থেকে দেড় ফুট লম্বা ও তেরছা করে কেটে বালি বা বেলে দোআঁশ মাটিতে বসিয়ে দিলে ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে তা থেকে শিকড় গজায়। তবে কাটিং রাখার জায়গায় শেড বা ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মাটিতেও রস থাকতে হবে। কাটিং সাধারণত মরে না, তাড়াতাড়ি ফল ধরে। কাটিং থেকে উৎপাদিত গাছে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই ফল ধরতে শুরু করে।
জমি ভালোভাবে চাষ ও সমান করে ৩ মিটার পরপর সবদিকে সারি করে চারা লাগাতে হবে। চারা রোপণের মাসখানেক আগে গর্ত তৈরি করতে হবে। প্রতি গর্তে ৪০ কেজি পচা গোবর, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম করে টিএসপি ও এমওপি সার, ১০ গ্রাম করে জিপসাম, জিঙ্ক সালফেট ও বোরাক্স সার দিতে হবে। বছরের যে কোনো সময় চারা লাগানো যেতে পারে। তবে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে লাগালে ভালো হয়। প্রতি গর্তে ৪টি করে চারা লাগালে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। চারা লাগানোর পর খুঁটি বা পিলার পুঁতে দিয়ে ড্রাগন গাছ বেঁধে দিতে হবে। কেননা ড্রাগনের গাছের কাণ্ড লতানো প্রকৃতির। তিন পদ্ধতিতে খুঁটি দিয়ে গাছটিতে সাপোর্ট দিতে হয়- ক. ভিয়েতনাম পদ্ধতি, খ. ফ্লোরিডা পদ্ধতি, গ. শ্রীলঙ্কা পদ্ধতি। ভিয়েতনাম পদ্ধতিতে পিলারের চারদিকে কাটিংকরা কলম চারা লাগিয়ে পিলারের সঙ্গে বেঁধে দিতে হয়। ফ্লোরিডা পদ্ধতিতে দুই পাশে দুটি খুঁটি পুঁতে মোটা তারের ওপর জাংলার মতো তৈরি করে গাছ জাংলায় তুলে দিতে হবে। আর শ্রীলঙ্কা পদ্ধতিতে পিলার পুঁতে চারা লাগিয়ে দিয়ে পিলারের সঙ্গে বেঁধে দিতে হয়। পিলারের চারদিকে বাঁশের মাচাংয়ের ওপর মোটরগাড়ির পুরনো টায়ার দিয়ে তার ওপর গাছের শাখাগুলোকে বাড়তে দেওয়া হয়।
ড্রাগন ফলগাছ খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। একটি এক বছর বয়সী গাছ ৩০টি পর্যন্ত শাখা তৈরি করতে পারে। চার বছর বয়সী গাছে প্রায় ১৩০টি শাখা তৈরি হয়। ড্রাগন ফলের গাছ সাধারণত দেড় থেকে আড়াই মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। একেকটি ফলের ওজন ১৫০ থেকে ৬০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ১২-১৮ মাস পর একটি গাছ ফল ধারণ করে। ফল সংগ্রহের পর ৪০-৫০টি প্রধান শাখার প্রতিটিতে এক-দুটি সেকেন্ডারি শাখা রেখে বাকিগুলো কেটে দিতে হয়। ১২ থেকে ১৮ মাস বয়সের একটি গাছে ৫ থেকে ২০টি ফল পাওয়া যায়; কিন্তু পূর্ণবয়স্ক একটি গাছে ২৫ থেকে ১০০টি ফল পাওয়া যায়। হেক্টরপ্রতি ফলন ২০ থেকে ২৫ টন।
একবার বাগান স্থাপন করলে অনায়াসেই ২০-২৫ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া সম্ভব। সাধারণত বছরে একবার ফলন পাওয়া যায়। তবে শীতের সময়টায় দিনের আলোর পর প্রায় চার ঘণ্টা করে প্রতি গাছের খুঁটিতে লাইট ব্যবহার করা গেলে সারা বছরই ফল পাওয়া সম্ভব। লাভ খরচের প্রায় দ্বিগুণ। তাই রফতানিযোগ্য এই ফলের ভবিষ্যৎ বাণিজ্যিক সম্ভাবনা অনেক। ইচ্ছে করলে বাড়ির ছাদে বা টবে শৌখিনভাবেও ড্রাগনের চাষ করা যেতে পারে।
লেখক : শিক্ষক, এইচডি গবেষক, উদ্ভিদরোগতত্ত্ব বিদ্যা, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়