সোহেল অটল, হ্যা লং (ভিয়েতনাম) থেকে ফিরে
প্রায় দুই হাজার ড্রাগন পাঁচশ মিলিয়ন বছর ধরে বসত গেড়ে আছে হ্যা লং সমুদ্রে। আছে বুড়ো ড্রাগন, বুড়ি ড্রাগন, এমনকি তাদের ছেলেপুলে, নাতি-নাতনিরাও।
হ্যা লং সমুদ্রের ১৫৫৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে তাদের বাস। সমুদ্রের নীল পানিতে মাথাগুঁজে আকাশমুখো করে রেখেছে তাদের লেজগুলো। দূর থেকে মনে হবে একেটা সবুজ পাহাড়। কাছে গেলেও পাহাড়ই মনে হবে। এই চুনাপাথরের পাহাড়ের রূপ নিয়ে জেগে থাকা ড্রাগনগুলোর বাস এখানে ছিল না। ভিয়েতনামের এই উপকূলের মানুষকে চৈনিক দস্যুদের হাত থেকে বাঁচাতেই তাদের এখানে আসা।

সে অনেক দিন আগের কথা। চৈনিক দস্যুদের উৎপাতে হ্যা লং উপকূলের মানুষ যখন ত্যক্ত-বিরক্ত, তখন তারা সর্বশক্তিমানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। তাদের আকুল প্রার্থনা কবুল হয়। হুট করে উপকূলবাসী দেখে কোত্থেকে এক ড্রাগন পরিবার এসে বসত গড়েছে উপকূলে। চৈনিক দস্যুদের জাহাজগুলো আটকে দিতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেছে উপকূল থেকে গভীর সমুদ্র পর্যন্ত। দস্যুদের জাহাজ ড্রাগনদের ভয়ে আর এগোতে পারেনি। জাহাজ ফেলে পালিয়ে বেঁচেছে তারা। তখন থেকেই ড্রাগনগুলো এখানকার অধিবাসী। আর ফিরে যায়নি। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেড়েছে তাদের। ড্রাগনরা সম্ভবত জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত নয়। সে কারণেই এ এলাকায় এখন ড্রাগনের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার।
ড্রাগনদের নিয়ে উপরের মিথলজি অবশ্য নৃতাত্ত্বিকগণ বিশ্বাস করেন না। তাদের দেওয়া থিওরি মতে, পাঁচশ মিলিয়ন বছর ধরে এই চূনাপাথরের পাহাড়গুলো তৈরি হয়েছে। ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ও সমুদ্রের পরিবেশগত পরিবর্তনই এমনটা করেছে। তা সে যেমন করেই হোক, হ্যা লং সমুদ্র যে পর্যটকদের জন্য এক অপার সৌন্দর্যের আধার নিয়ে বসে আছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য এই হ্যা লং বে পর্যটকদের চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য নিয়ে বসে আছে। ১৫৫৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা এমন চুনাপাথরের পাহাড়ে সয়লাব। স্থানীয় মিথলজি মাথায় নিয়ে এখানে ঢুকলে এক অন্যরকম ঘোর কাজ করে। পাহাড়গুলোর ভেতরে অসংখ্য গুহা। গুহার ভেতর বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক ভাস্কর্য। যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি নিজের হাতে এমনটা করে রেখেছে। কোথাও কোনো কিছুর বিন্দু পরিমাণ অসঙ্গতি নেই।
পর্যটক আকর্ষণের জন্য সম্প্রতি ভিয়েতনাম সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পর্যটকদের নির্বিঘ্ন ঘোরাঘুরিসহ নানান উদ্যোগ রয়েছে। প্রায় কুড়ি বছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধের পর ১৯৭৫ সালে বিজয়ী হয় দেশটি। এতদিনের যুদ্ধের ক্লান্তি কাটিয়ে দেশটি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা আনাচকানাচ পর্যটকবান্ধব করার সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সে দেশের সরকার। সুতরাং ভিয়েতনামে গিয়ে ঘোরাঘুরির আনন্দ পুরোপুরি উপভোগ করা সম্ভব। বাড়তি হিসেবে পাওয়া যাবে ভিয়েতনামের মানুষের আন্তরিক ব্যবহার।
হ্যা লং সমুদ্রে ড্রাগন পরিবারকে স্বচক্ষে দেখার জন্য নানান ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যে ক্রুজের মাধ্যমে সমুদ্রে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। অথবা ছোট ছোট নৌকা ভাড়া করে ব্যক্তিগতভাবে সমুদ্র ঘুরে দেখার ব্যবস্থাও রয়েছে। যেভাবেই হোক, হ্যা লং সমুদ্রে একবার ঢুকলে ফিরে আসতে মন চাইবে না। নিজেকেও ড্রাগন পরিবারের অংশ করে ওখানেই বাকি জীবন কাটাতে মন চাইবে।
রাজধানী হ্যানয় থেকে ১৫৬ কিলোমিটার স্থলপথ পাড়ি দিয়ে হ্যা লং পৌঁছাতে হয়। চমৎকার হাইওয়ে ও পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে তাদের। থাকা-খাওয়ার খরচ বাংলাদেশ থেকেও কম। প্রচুর চাইনিজ রেস্তোরাঁ রয়েছে ভিয়েতনামে। শুধু বিমান ভাড়া একটু বেশি। প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ হবে ঢাকা থেকে হ্যানয় যাওয়া-আসার জন্য।