ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং ৩২ ধারা

কথাসাহিত্যিক, সাবেক যুগ্ম সচিব আফরোজা পারভীন

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং ৩২ ধারা

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমাদের সমাজ দিন দিন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে। সে নিরাপত্তা শারীরিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক— সবরকম। দেশে ডিজিটাল প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যাও ব্যাপকভাবে বাড়ছে। গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে গেছে ব্যবহারকারীরা। দোকানদার, কাজের বুয়া, ড্রাইভার থেকে শুরু করে শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে অধিকাংশ মানুষ এখন ফেসবুক ব্যবহার করছে। অনেকেই প্রতিনিয়ত নেটে যাচ্ছে। ম্যাসেঞ্জার ইমো ভাইভার টুইটার ব্যবহার চলছে ঘরে ঘরে। ফলে চিঠিপত্র ফোন মোবাইলের আবশ্যকতা এখন অনেকটাই কমে গেছে। দৈনন্দিন আলাপ-আলোচনা এখন অধিকাংশ লোকই ম্যাসেঞ্জারে সেরে নেয়। এতে সুবিধা অনেক, কম পয়সায় বেশি সুযোগ পাওয়া যায়। আজকাল অফিস-আদালতে তো কথাই নেই, ঘরে ঘরে ওয়াইফাই। মোবাইলে ডাটা ভরে ঘুরছে সবাই। কাজেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নেই। তাছাড়া টাওয়ারের কারণে রাস্তার অনেক জায়গাতেই ফ্রি ওয়াইফাইও পাওয়া যায়। মোটকথা, ডিজিটালি অনেক এগিয়ে গেছে দেশ। খবরের কাগজ পড়ার জন্য এখন আর কেউ হাপিত্যেশ করে সকালের জন্য বসে থাকে না। নেটে পড়ে নেয়। যে কোনো সরকারি আদেশ সার্কুলার প্রজ্ঞাপন সবই এসে যায় নেটে আর সেখান থেকে ফেসবুকে। তথ্যপ্রাপ্তি এখন অনেক সহজ।

এই সহজলভ্যতার কারণে বেশকিছু অসুবিধায়ও পড়তে হচ্ছে আমাদের। ফেসবুকে যে যা ইচ্ছে লিখছে, গুজব ছড়াচ্ছে। ক্রাইম বাড়ছে। রাষ্ট্র ও সমাজবিরোধী কথাবার্তা চলছে ফেসবুকে। যেমন ভালো খবর আমরা পাচ্ছি, তেমনি প্রতিনিয়ত পাচ্ছি অসংখ্য ভুয়া খবর। এ জিনিসটি আমরা ব্যাপকভাবে দেখি হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার সময়। দেখি কিশোর আন্দোলনের সময়। তথ্য যাচাই না করে যার যা ইচ্ছে বলতে থাকে। ফলে সমাজে ঘটে বিপুল প্রতিক্রিয়া। এই গুজব রটনাকারীরা অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে, কেউ কেউ রিমান্ডে গেছে। অনেককে এখনো পুলিশ খুঁজছে। অনেকে জামিনও পেয়েছে। হ্যাঁ, একথা ঠিক, যে কথা রটেছে তার পুরোটাই গুজব নয়। কিন্তু সেটা যাচাইও হয়নি। ফেসবুকে মানুষের বিরুদ্ধে মানহানিকর কথা চলছে, রাষ্ট্র ও সমাজবিরোধী কথা চলছে, ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত হেনেও কথা চলছে।

পৃথিবীর সব দেশেই তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন আছে। বাংলাদেশেও আছে। এই আইনটি তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০৬ নামে অভিহিত। এই আইনটিতে নয়টি অধ্যায় রয়েছে।

অষ্টম অধ্যায়ে বর্ণিত ৫৭ ধারায় ২টি উপধারা রয়েছে। উপধারা ১ নিম্নরূপ : কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল এবং সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহা দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।

উপধারা ২-এ বর্ণিত হয়েছে : কোন ব্যক্তি উপধারা ১-এর অধীন অপরাধ করিলে অনধিক চৌদ্দ বৎসর এবং অন্যূন সাত বছর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। ২০০৬ সালে প্রণীত এই আইনটিতে ‘অনধিক দশ বছর কারাদণ্ডের স্থলে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন ২০১৩’ (২০১৩ সালের ৪২ নং আইন)-এর ৩ ধারামূলে প্রতিস্থাপিত। এই ৫৭ ধারায় সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ হয়রানির শিকার হন। ফলে নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব), বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের সব সংগঠন একযোগে এ ধারা বাতিলের দাবি তোলে। পরে সরকারের পক্ষ থেকে ধারাটি বাতিলের আশ্বাস দেওয়া হয়। এরপর গত জানুয়ারি মাসে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হওয়ার পর এটি ঘিরেও বিতর্ক ও সমালোচনা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আপত্তি ওঠা কিছু ধারা বাদ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল।

কিন্তু জাতীয় সংসদে বিলটি উত্থাপনের পর দেখা যায়, তেমন কোনো সংশোধন তো আনা হয়ইনি; উপরন্তু বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো ‘ডিজিটাল গুপ্তচর বিষয়ক ৩২ ধারা’র মতো একটি কঠোর নতুন ধারা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সংসদে জাতীয় পার্টি বিলটিতে আপত্তি জানালে বিলটি চার সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল। প্রস্তাবিত আইনটির কয়েকটি ধারা নিয়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত বা তাদের প্রতিনিধিরাও আপত্তি জানিয়েছিলেন। আপত্তি জানিয়েছিল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, দেশে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন ও ইউনিয়ন। সংগঠনগুলো আইনের কঠোর ও বিতর্কিত কিছু ধারা বাদ দেওয়ার দাবি তোলে। এসব দাবি আমলে না নিয়ে মন্ত্রিসভায় পাস হওয়া খসড়াটিই প্রায় হুবহু জাতীয় সংসদে বিল আকারে উত্থাপন করা হয়।

প্রস্তাবিত আইনের ৩২ ধারায় ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্যউপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। আবার এই ধারাটি অজামিনযোগ্য। এই ধারা নিয়েই সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হচ্ছে।

আইনের ২৯ ধারায় মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও সম্প্রচারের বিষয়ে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানি সংক্রান্ত দণ্ডবিধির (১৮৬০) সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত অপরাধ সংঘটন করেন, তাহলে তার জন্য শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড। আর অপরাধটি দ্বিতীয় বা বার বার করলে অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ দশ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে।

আইনের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা বা প্রচারণা চালান বা তাতে মদত দেন, তাহলে তা অপরাধ হবে। এ অপরাধের শাস্তি ১৪ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর বার বার করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনাশ করে, অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয়, তাহলে তা হবে একটি অপরাধ। এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই ধারার অপরাধে জামিন হবে না।

প্রস্তাবিত আইনে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে গুপ্তচরবৃত্তি, ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্ট, মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রচারণার মতো বিভিন্ন অপরাধ ও এর সাজা নির্ধারণ করা হয়েছে।

শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরে বসে কেউ এই আইনের অধীনে এমন অপরাধ করলে এই আইনে বিচার করার বিধান রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত এই আইনের ১৪টি ধারার অপরাধ হবে অজামিনযোগ্য।

৩২ ধারার কারণে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে। এটি একটি বৈরী আইন। এই আইন সাংবাদিকদের শৃঙ্খলিত করে ফেলবে। আমরা সবাই জানি সোর্স ব্যবহার করে সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহ করেন। এই আইনের ভীতিতে সোর্সরা সাংবাদিকদের সাহায্য করবেন না আর সাংবাদিকরাও সোর্স উল্লেখ করা যাবে না বলে সংবাদ ছাপবেন না। ফলে দুর্নীতি ঘুষ ইত্যাকার অপরাধ রয়ে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

আমাদের সংবিধানে বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ করতে গিয়ে কাউকে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা সমীচীন হবে না। জামিন অযোগ্য ধারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে বিতর্ক ছিল; কিন্তু হতাশার কথা এটাই যে, ৫৭ ধারার পুরোটাই প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন ধারায় সংযোজন করা হয়েছে। উপরন্তু জুড়ে দেওয়া হয়েছে ৩২ ধারা।

এ কথা ঠিক, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাংকগুলো থেকে একের পর এক টাকা পাচারসহ নানা ধরনের সাইবার অপরাধ হচ্ছে। কিন্তু সেই অপরাধ ঠেকানোর যথোপযুক্ত ব্যবস্থা না করে নতুন নতুন আইন পাস করা সমীচীন হবে না। বিশেষ করে ৩২ ধারার মতো ধারা সংযুক্ত হলে এদেশের মানুষ একসময় ভয়ে কথা বলতে ভুলে যাবে।

ডিজিটাল ব্যবস্থার ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ হোক আমরা এটা চাই। কিন্তু সাথে সাথে এটাও চাই যে, আইন যেন মানুষের জন্য হয়, আইনের জন্য মানুষ না হয়।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাবেক যুগ্ম সচিব

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads