মুক্তমত

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংস্কার অপরিহার্য

  • প্রকাশিত ১২ মার্চ, ২০২১

মুহম্মদ সজীব প্রধান

 

 

 

দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের লালনের জন্যই পৃথিবীতে আইনের উৎপত্তি। কিন্তু যখন আইনের প্রণয়ন ও প্রয়োগে অস্বচ্ছতা সৃষ্টি  হয় তখন এ কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা হয়ে যায়। ডিজিটাল ডিভাইস ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে বেশিরভাগ মানুষই এখন ইন্টারনেট সেবার আওতাভুক্ত। এক শ্রেণির মানুষ এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ডিজিটাল অপরাধ সংঘটিত করছে। ফলে ভার্চুয়াল ও বাস্তব উভয় জগতে দেখা দিচ্ছে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য। এমন অপরাধের লাগাম টেনে ধরতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও নির্দিষ্ট কিছু আইনকানুন রয়েছে। বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ২০০৬ সালে প্রথম ‘তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন-২০০৬’ তৈরি করা হয়। কিন্তু এ আইনের ত্রুটিপূর্ণ প্রয়োগ ও হয়রানির আশঙ্কা নিয়ে, বিশেষত ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয় বিভিন্ন মহলে। পরে সরকার আইসিটি আইন থেকে বিতর্কিত ধারাগুলো বিলুপ্ত করলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮-এ সেগুলো পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার মতো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ৯টি ধারা বাতিল কিংবা সংস্কার করতে জোরালো দাবি জানানো হয়; কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এ আইনের সমালোচিত ধারাগুলোতে অপরাধের স্পষ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নেই। ফলে অপপ্রয়োগের সুযোগ রয়েছে বলে আইনবিজ্ঞরা মনে করেন। আইনটির অন্যতম সমালোচিত ধারা ৩২, যেখানে গুপ্তচরবৃত্তির কথা বলা হয়েছে। এ ধারাটিতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ, স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং নাগরিকদের তথ্য জানার অধিকারকে রুদ্ধ করার আশঙ্কা শুরু থেকেই ছিল। সত্যি বলতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মামলা করা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। তা ছাড়া অনেক লেখক, বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার কর্মীও এখন বলিষ্ঠভাবে দেশ ও জনগণের পক্ষে মত প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করেন। সমালোচিত এ আইনে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করার অনুমতি পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। ফলে অনেক নিরপরাধ মানুষও ষড়যন্ত্রের শিকার হতে পারেন। এ ছাড়া আমাদের সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদে যে চিন্তা ও বিবেক এবং বাক্স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে তা খর্ব হবে যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে আমজনতার মতো প্রকাশের অধিকার হরণ করা হয়। রাষ্ট্রে আইন প্রণয়ন করার উদ্দেশ্যই হচ্ছে জনগণের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। কিন্তু পরবর্তীসময়ে আইন জনগণের জন্য কল্যাণকর নাকি অকল্যাণকর হবে তা নির্ভর করে আইনের প্রয়োগ প্রক্রিয়ার ওপর। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

আগের আইসিটি আইন ও বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা সারা দেশের মামলাগুলোর বিচার হচ্ছে ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালে। এ আদালতে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিচারের জন্য মামলা এসেছে ২ হাজারেরও বেশি, যার অধিকাংশই সাক্ষ্যপ্রমাণে টিকছে না। এর কারণ হচ্ছে এ আইনকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে অনেকে ব্যক্তিগত ক্ষোভ কিংবা প্রতিহিংসাকে কেন্দ্র করে হরহামেশা অপরকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলা করছে। উদ্বেগের আরো একটি কারণ হলো, এ আইনের ১৪টি ধারায় জামিন অযোগ্য। যেখানে দেশে খুন, ধর্ষণ ও দুর্নীতির মতো বড় বড় অপরাধ করেও জামিন পাওয়ার দৃষ্টান্ত অহরহ, সেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জামিন না পাওয়া কতটা যৌক্তিক সে বিষয়েও রয়েছে অনেক প্রশ্ন। এমতাবস্থায় অনেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের পক্ষে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল নাকি সংস্কার প্রয়োজন? যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয় তাহলে সাইবার ক্রাইমে দেশ অপরাধের আখড়ায় পরিণত হতে পারে। ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করা এবং এর সূত্র ধরে বিভিন্ন ধর্মানুসারীদের রেষারেষির চিত্র নতুন নয়। আমাদের সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদে যেমন চিন্তা ও বিবেক এবং বাক্স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে তেমনই সংবিধানের ৪১ নং অনুচ্ছেদে ধর্মীয় স্বাধীনতাও দেওয়া হয়েছে। কাজেই আমরা চাইলেই অন্য ধর্ম নিয়ে অসঙ্গত মতামত প্রদান করতে পারব না। তা ছাড়া গুজব ছড়িয়ে সর্বসাধারণকে বিভ্রান্ত করা, অন্যের ব্যক্তিগত ছবি কিংবা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইউটিউবে প্রকাশ করে মানহানি করা আজকাল ভাইরাসের মতো ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। অন্যদিকে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট, জিমেইল, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নষ্ট করা ভয়াবহ অপরাধ। আমরা দেখেছি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের সঙ্গেও ডিজিটাল অপরাধীদের সম্পৃক্ততা। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো যখন সাইবার ক্রাইম নিয়ে উদ্বিগ্ন তখন আমাদের মতো ছোট একটি দেশে সাইবার ক্রাইমের ভয়াবহতা নিয়ে অবহেলা করার কোনো জো নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পৃথিবীতে পরের যুদ্ধগুলো সাইবার যুদ্ধই হবে। তাই আমাদের দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে ডিজিটাল অপরাধ প্রতিহত করা জরুরি। সে দৃষ্টিকোণ থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োজন, তবে আইনের কোনো অংশ যেন জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতাকে কেড়ে না নেয় সেদিকে দৃষ্টি রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল নয়, বরং সংস্কার করা অপরিহার্য।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads