জীব ও পরিবেশ

ট্যানারি বর্জ্যে পোল্ট্রি ফিড উৎপাদন চলছেই

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৪ অগাস্ট, ২০১৯

বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্যে পোল্ট্রি ফিড উৎপাদন থামছেই না। শুধু স্থান বদলেছে, ঘটনা আগের মতোই আছে। পূর্বে রাজধানীর হাজারীবাগে ট্যানারি বর্জ্য দিয়ে তৈরি হতো পোল্ট্রি ফিড, এখন হচ্ছে সাভারে। ট্যানারিগুলো স্থানান্তর হওয়ার পর একইভাবেই তৈরি হচ্ছে পোল্ট্রি ফিড।

জানা যায়, গত এক দশকে দেশে বাণিজ্যিকভাবে হাঁস-মুরগি পালন বেড়েছে। এটি এখন বেশ লাভজনক ব্যবসা। আর হাঁস-মুরগির খাবার (পোল্ট্রি ফিড) তৈরি করে এসব খামারে সরবরাহ করাটাও লাভজনক। দেশে বছরে পোল্ট্রি ফিডের চাহিদা প্রায় ৪০ লাখ টন। প্রতি কেজির দাম গড়ে ৪০ টাকা হিসেবে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার পোল্ট্রি ফিড বেচাকেনা হয়। এ খাবারের জোগান দিচ্ছে নিবন্ধিত ২১৮টি প্রতিষ্ঠান।

কষ্টের বিষয়, কিছু কোম্পানির পোল্ট্রি ফিডে এখনো মিলছে বিষাক্ত ট্যানারির বর্জ্য। চামড়ার বর্জ্যের ক্ষতিকর উপাদানগুলো দিয়ে মাছ ও মুরগির খাবার তৈরি হচ্ছে। এসব খাবার খাওয়ানোর ফলে বিষাক্ত হয়ে পড়ছে মাছ-মুরগি। আগে হাজারীবাগ এলাকায় তৈরি পোল্ট্রি ফিডে ট্যানারি বর্জ্য পাওয়া গিয়েছিল। সাভারে স্থানান্তরের পরও অবস্থা বদলায়নি। চলতি বছরেই তিনটি পোল্ট্রি ফিড সরবরাহকারী ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করেছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।

একাধিক সূত্র জানায়, সাভার এলাকায় তিনটি পোল্ট্রি ফিড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে ১ লাখ ৫ হাজার টন ট্যানারি বর্জ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সাভারের ভার্কুতাতেই এক লাখ টন, আমিনবাজারে দুই হাজার টন ও ভার্কুতা মোগড়াকান্দায় তিন হাজার টন বর্জ্য পাওয়া যায়। রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পকে ঘিরে এর আশপাশে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য বিষাক্ত পোল্ট্রি ফিড তৈরির কারখানা। সম্প্রতি এসব ট্যানারি সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হয়েছে। হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের হরিণধরা গ্রামে গড়ে ওঠা চামড়াশিল্প নগরীর একেবারে উত্তর প্রান্ত ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বর্জ্য পোড়ানোর খামারগুলো। বর্জ্য পোড়াতে সেখানে প্রায় ৪০টির মতো চুলা রয়েছে। আর সেখানেই তৈরি হচ্ছে বিষাক্ত পোল্ট্রি ফিড।

সরেজমিন দেখা যায়, অসাধু ব্যবসায়ীরা কখনো গোপনে, কখনো প্রকাশ্যেই ট্যানারির বর্জ্য জ্বালিয়ে বিষাক্ত পোল্ট্রি ফিড তৈরি করে দেশের বিভিন্ন এলাকার খামারে সরবরাহ করছে। এসব ফিডে থাকছে ট্যানারির চামড়ায় ব্যবহূত রাসায়নিক ক্রমিয়াম, সালফিউরিক অ্যাসিড, লাইম, সোডা, ফরমিকা, ক্লোরাইড, সালফেট, অ্যালুমিনিয়াম সালফেট প্রভৃতি। এসব বিষাক্ত উপাদান মুরগি ও মাছের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে মানব শরীরেও।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত পোল্ট্রি ফিড। এ বাজারে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। পোল্ট্রি ফিডের প্রধান উপাদান ভুট্টা ও সয়াবিন, এর ৭৫ শতাংশই বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। বাকি অংশ আর্জেন্টিনা, ভারত ও ব্রাজিল থেকে আমদানি করা হয়।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (ডিএলএস) ডা. এ বি এম খালেদুজ্জামান বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পোল্ট্রি ফিডে ট্যানারি বর্জ্য দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। নিয়মিত সম্মিলিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছি। পোল্ট্রি ফিডে ট্যানারির বর্জ্য মেশানোর অপরাধে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে।

এদিকে বিষাক্ত ট্যানারি বর্জে পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ ফুড সেফটি নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান মহিদুল হক খান বলেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। হাইকোর্টের আদেশ মেনে নিষিদ্ধ বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য দিয়ে তৈরি ফিড বর্জন করতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। 

বাপা’র যুগ্ম সম্পাদক ও নিরাপদ খাদ্য, পানীয় ও ভোক্তা অধিকার কর্মসূচির সদস্য সচিব জাহেদুর রহমান বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য দেশবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। চামড়ার বর্জ্য থেকে পোল্ট্রি ফিড তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি এতটা ভয়াবহ যে, না দেখলে বিশ্বাস হবে না। এতে বাড়ছে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং দূষিত হচ্ছে স্থানীয় কৃষিজমি, নদীর পানি, বাতাস ও পরিবেশ। তিনি বলেন, চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার জন্য শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কমপক্ষে শতাধিক ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। চামড়া ফিনিশিং প্রক্রিয়ার শেষ স্তর পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে সবচেয় ভয়াবহ হলো ক্রোমিয়াম। এটি আগুনে জ্বালালেও কোনো ক্ষয় নেই। মাটিও হজম করতে পারে না। কিন্তু সেই কেমিক্যাল আমাদের দেহে প্রবেশ করে। তিনি আরো জানান, ক্রোমিয়াম ও সিসা মানবদেহে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি প্রবেশ করলে মানুষের লিভার, কিডনি, ব্রেন ও নার্ভাস সিস্টেম অচল হয়ে যায়। এতে একদিকে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে নারীর প্রজনন ক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads